সূচীপত্র

শুক্রবার, এপ্রিল ১৪, ২০১৭

শুভ নববর্ষ ১৪২৪

মিন্টু শাহজাদা

গত রাতে অনেকক্ষণ ইলেকট্রিসিটি ছিল না। রাতে ঘুমাতে দেরি হওয়ায় আজ সকালে বিছানা ছাড়তে দেরি হয়েছিল। ঘুম ভেঙে উঠব উঠব করছিলাম এমন সময় দেখি দুধ কলা মাখানো ভাত নিয়ে আমার সহধর্মিনী এলেন এবং মুখ না ধোয়া অবস্থায়ই আমাকে খাইয়ে দিলেন, আমার তো আধোয়া হাত।খেতে বলায় তিনিও খেলেন। গতবারেও এমন হয়েছিল। তখন এর মর্ম বুঝিনি। পুনরাবৃত্তি হওয়ায় বুঝলাম এটি ঐতিহ্য এবং চলবে। দুয়া পড়ে আমাকে ফু দিলেন। আমার ভালই লাগল।
সকালটা চমৎকার ছিল। রাতে ঘুমও হয়েছিল দারুণ। সিগারেট ছিল না। সিগারেট কিনতে গিয়ে নিচে নেমে দেখি বাইরে আগুন ঝরছে। বেরুতে চেয়েছিলাম কোথাও। কিন্তু ওঁর শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে বেরুলাম না। মা’র সাথে কথা বললাম। আব্বা আগেই ফোন করেছিলেন এবং আরো অনেকেই। ফোন সাইলেন্ট ছিল বলে টের পাইনি। কেউ কেউ মেসেজও দিয়েছেন দেখলাম।শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।আব্বার সাথে কথা হল। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী এবং ভাই বোনদের সাথে কথা হল। ঠিক করলাম রোদ পড়লে গ্রামে যাব ঠান্ডা হাওয়া খেতে। আমার এখান থেকে কেরানিগঞ্জের গ্রামগুলো বেশি দূরে নয়। খুব দ্রুত এবং সহজেই যাওয়া যায় এবং ফিরে আসা যায়।
বেশ কয়েকবার ফেসবুকে ঢু মারতেই দূপুর গড়িয়ে গেল। খেয়ে দেয়ে আরো একটা ঘুম দিলাম। উঠে গোসল টোসল সেরে কেরানিগঞ্জে গেলাম। মোহাম্মদপুর থেকে আটিবাজার পেরিয়ে সামনে গেলেই গ্রাম। আসল গ্রামের স্বাদ হয়ত পাওয়া যাবে না ওখানে।ইট পাথরের ঘর দিয়েই গ্রামটি মোড়ানো।তবুও সবুজ ইরি ক্ষেত দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।ইরি ক্ষেতে নেমে ঠান্ডা বাতাসে খুব আরাম পেলাম।বেশ কিছুক্ষণ ক্ষেতের আইল ধরে হাটলাম। ওখানে আমাদের এক আত্মীয় সাথে ছিল। ওর বাড়ি ওখানেই। প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল, প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। মনে হল I want what, I want when, I want it. আহ!
বসিলা ব্রিজের ওপর থেকেই মানুষের ঢল। বৈশাখী সাজ ও উৎসবে সবাই মেতে উঠেছে।বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম ট্রাকে সাউন্ড বক্স রেখে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে ছেলেরা নাচছে। আমারও ইচ্ছে করছিল একটু নাচি।তা তো আর হয় না। ওরা ছোট ছোট। আমাকে চেনেও না। মেয়েগুলো সেজেগুজে ঘুরছে, সাথে বাচ্চারা। আমার ভীষন ভাল লাগছিল। একে তো শীতল হাওয়া তার উপরে আবার দারুণ ফূর্তি। কি মজা!
তারানগর মোড়ে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেলাম।হিন্দু, মুসলিম একাট্টা হয়ে ওখানে কি নিবিড়ভাবে আড্ডা দিচ্ছে। আমার আত্মীয়ের পরিচিতদের সাথে পরিচিত হলাম। গল্প করলাম। চায়ের বিল দেওয়া নিয়ে একটু ঠেলাঠেলি করলাম। অত:পর পরাস্ত হলাম। কোনভাবেই বিলটা দিতে দেওয়া হলো না। এইযে মানুষগুলো। এরা কোন তত্ত্ব বোঝে না, তথ্য বোঝে না। সাম্প্রদায়িকতা কি তাও বোঝে না। এরা ভালবাসা বোঝে, আপ্যায়ন বোঝে, সম্মান বোঝে। এরা তো আমাদের মত বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা কেউ না। অথচ কি সুন্দর মন ও মানসিকতার মানুষ এরা্।

ছোটবেলায় আমাদের ওখানে পয়লা বৈশাখে মেলা হত। আমাদের দেশে বলে আড়ং।গ্রামের ঐতিহ্য মত মা খই ভেজে দিতেন।যেহেতু আমি বড়, তাই মাথায় করে খই নিয়ে আড়ং এ বিক্রি করতাম। ওখানে কত কি খেলনা উঠত। খই বেচা টাকা দিয়ে সামর্থের মধ্যে খেলনা কিনতাম, বাঁশি কিনতাম, বোনদের জন্য মাটির পুতুল কিনতাম, আমার ভাইয়ের জন্য গাড়ি কিনতাম।সাজ বাতাসা, জামাই কুলকুলি, আড়হা, মুরালি, কটকটি কিনতাম।টাকা বাঁচলে শেষে নাগড়দোলায় চড়ে বাড়ি ফিরতাম। ছোট ভাইবোনগুলো সারাদিন ধরে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকত- ভাইয়ের অপেক্ষায়। বাড়ির কাছাকাছি আসতে না আসতেই ওরা দৌড়ে আসত। কিচিরমিচির করে আমাকে ঘিরে ধরত। আহ! সেসব কথা মনে হলে চোখ ভিজে যায়। কি আনন্দ ছিল! এখন যে আনন্দ নেই, তা নয়। এখনকার আনন্দ আলাদা্। এখন তো কেবল ঈদে কিংবা কোন প্রয়োজনে বা অন্য কোন কারণে বাড়ি গেলে আনন্দ হয়। সবাই বড় হয়ে গেছে। সবার সংসার হয়েছে। তবুও ওরা আমাকে বড় ভালবাসে। সম্মান করে। আগে ওদেরকে কোন কারণে সকালে মারলে দুপুরে ভুলে যেত। আর এখন কোন কারণে বকাঝকা করলে এক সপ্তাহ, কখনও কখনও একমাস পরে কথা বলে।তবে মা কিংবা আব্বার কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে লুকিযে আমার আপডেট জানে। অবশ্য আমিও তাই করি। বড় হলে এমন হয়।
যাহোক, আমাদের গ্রামে মেলা হলেও কখনও শোভাযাত্রার কথা শুনিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ওখানে বৈশাখী র‌্যালি (শোভাযাত্রা) হত। মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। সকালেবেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। নানারকম দেশীয় ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাও হত। এই যেমন চোখ বেঁধে হাড়ি ভাঙা আরো কত কি! অনুষ্ঠানে আমি গানও করতাম।অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে থেকে রিহার্সেল করতাম। খুব আনন্দ হত।আমার ভীষন ভাল লাগত।কিছুদিন ধরে শুনছি এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে এদেশীয় সাধারণ মুসলিমদের কারো কারো মধ্যে এক ধরণের কনফিউশন (দ্বিধা) তৈরি হয়েছে। আমার কথা হল, মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে যেহেতু কনফিউশন আছে। তাহলে এই কনফিউশন দূর করলেই হয়।কিংবা এর নাম পরিবর্তন করে অন্য নামও রাখা যেতে পারে।নামে কি আসে যায় বলুন। অনেকে তো ’বৈশাখী র‌্যালি’ কিংবা ’আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামেও শোভাযাত্রা করেছে। তখন তো এগুলি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে কেউ কেউ দোষারোপ করছেন এই বলে যে, এ বিভেদ তাদের সৃষ্টি। তাহলে তাদেরকে সুযোগ করে দেবার কি দরকার?
দেখুন, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার সব মানুষ আমাদের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি। এরা পরিশ্রম করে আমাদের জন্য আহার যোগায়। আমাদের তাত্ত্বিক কথার মানে তাঁরা বোঝে না।সাম্প্রদায়িকতা কি তা তো বোঝে না। তাঁরা মাটি বোঝে, মানুষ বোঝে। যে কৃষক, যে শ্রমিক সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একসাথে বসে যাত্রা গান শোনে। সকাল হলে ফজর নামায পড়ে কিংবা ঠাকুর কে প্রণাম করে কাজে যায় তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে কি লাভ বলুন? আমরা বাঙালি। আমাদের সব কিছুর ঊর্ধে পারিবারিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি, অনুশাসন, ভালবাসা। এগুলোতে আমাদের শান্তি, অস্তিত্ব। আমাদের একরোখা নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তাঁদের মনে বেদনার জন্ম দিয়ে কি লাভ, ভাই? ধর্ম ব্যবসায়ীদের কথা ছাড়ুন। তাদের তো নীতি নেই। আপনি প্রগতিশীল, জ্ঞানী। আমাদের প্রাণের দেশ, প্রাণের মানুষগুলির জন্য আপনারাই তো ভাববেন, প্রয়োজনে নতুন করে ভাববেন। আর কে আছে বলুন?
১৪ এপ্রিল ২০১৭, ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন