সূচীপত্র

মঙ্গলবার, জুলাই ২৫, ২০১৭

আষাঢ় মাসের গল্প



মিন্টু শাহজাদা

।এক।

সকালে ঘুম ভেঙেই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে আজগরের। গ্যারেজ মালিক খুব জ্বালাচ্ছে আজকাল। খালি টাকা টাকা করে। গাড়ি চাইলে বলে-গাড়ি নাই। বাকি টাকা চায়।জোরাজুরি করে আজগর।বলে- ‘খুব মুছিবদে আছি মাহাজন সাব। এইবারের মতন দ্যান। কামাই বাড়লে দিয়া দিমু, কসম কইতাছি।’ কাকুতি মিনতি করতে হয়। শেষ পর্যন্ত গাড়ি দিলেও সেই মরা-ধরা, ভাঙা-চোরা গাড়ি। চালিয়ে জুত নাই। প্যাডেল মারলে এগুতেই চায় না। খালি গাড়ি টানার সময়ও মনে হয় পাঁচ মণ ভার নিয়ে টানছে গাড়ি। জমার টাকা মাঝে মাঝে একটু কমই দেয় আজগর। ইচ্ছা থাকলেও দিতে পারে না। ঘরে পোয়াতি বউ, ওষুধ কিনতে কিনতে জান শেষ। ছোট মেয়েটারও জ্বর। বড়টা তো জন্ম থেকেই লুলা। সারাদিন শুয়ে শুয়ে ক্যাও ক্যাও করার তালেই আছে।
সংসারের সদাই, বউয়ের ওষুধ, সমিতির কিস্তি, মাস শেষে ঘর ভাড়া, তার উপর আবার বউয়ের ঘ্যানঘ্যানানি- এটা নাই, ওটা নাই, কাহাতক সহ্য হয়? “শালার মাগীও আছে। ভাবচক্কর দেইখা মনে হয়, দুনিয়াতে পোয়াতি সে একলাই হইছে। সারাদিন খাটাখাটনি শ্যাষ কইরা এট্টু শান্তিমত চাইড্ডা ভাত খামু, হেইডারও জো নাই। আইজকাল কি সব রান্ধে না রান্ধে, মুখেই দেওনের উপায় নাই। এই পোলাপাইনের জ্বালায়ও তো ঘরে ফিরন দায়। কয়- বাজান এইডা দেও, ওইডা দেও। আরো একটা তো বিয়ানির সময় হইল বইলা। এইডাও আবার মাইয়া হয় কি না কে জানে? বিয়ানির সময় তো আবার ডাক্তরের কাছে নিওন লাগব, ডাক্তরে প্যাট কাডব, এত্তগুলান ট্যাহা চাইব। আল্লায় আমারে মরণ দেয় না ক্যারে?” ভাবতে ভাবতে বিছানা ছাড়ে আজগর।
-‘ভাইজান আইছিল কাইল।’ কোঁকাতে কোঁকাতে বলে ওঠে আজগরের বউ।
– হ, আইছে তো আমি কি করমু?
– ধারের ট্যাকাগুলান দিতে কয়। হ্যারও খুব সমেস্যা।
ক্ষেপে ওঠে আজগর। ‘বিয়ান ব্যালা উঠতে না উঠতেই বালের প্যাচাল। মাগী তোরে না কইছি আতে অইলে  দিয়া দিমু’
– অনেকদিন ধইরাই তো ঘুরাইতাছেন। ভাইজানগো তো আর জমিদারি নাই।রিস্কা চালাইয়া আর কত পায়? ধার কইরা আইনা আপনেরে দিছে।
– চুতমারানি কয় কি দ্যাহো। ট্যাকাগুলান কি আমি খাইছি? তোর পাছেই তো ভাঙছি। দুই দিন পর পর বিয়াস আর আমারে জ্বালাইয়া মারস। ক্যান মাগী, প্যাটটারে ত্যানা দিয়া বাইন্ধা রাখতে পারস না?
-কথাবার্তা সাবধানে কইবেন কইলাম। ওই গোলামের ঘরের গোলাম, বিয়ানি কারে কয়? বিয়ানি কারে কয়?
– কি কইলি মাগী?
বলেই বউয়ের দিকে তেড়ে যায় আজগর।মারার জন্য হাত উঠায়। কি মনে করে আর মারে না। হনহন করে বের হয়ে যায়। একটু পরে, বস্তির স্যাঁতসেতে গলির শেষমাথার ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়।

।দুই।

অফিস থেকে বের হয়েই বৃষ্টি। খালিদ বেশ খানিকটা চিন্তিত। বৃষ্টি থামারও তো নাম নেই। আষাঢ়ে বৃষ্টি। থামার অপেক্ষা করাও বোকামি। কতক্ষণে বাসায় ফিরতে পারবে কে জানে। ওদিকে সাবিনার শরীরটাও বেশি ভাল না। যত তাড়াতাড়ি ফেরা যায় ততই ভাল। সাবিনা বার বার ফোন করছিল। কন্সিভ করার পর থেকে ওর ফোনের পরিমাণ বেশ বেড়েছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ওদের নতুন প্রেম হল, তখনকার মত। দিনে দূপুরে, রাতে বিরাতে কত ফোন! এখনকার ফোন অবশ্য অন্য কারণে। একলা বাসায় কেন যেন ইদানিং ওর খুব ভয় হয়। আগে এমন হত না। এখন তো বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলেই কেমন অস্থির হয়ে যায়। কন্সিভ করলে বোধ হয় মেয়েদের কারো কারো এমন হয়। সবসময় কেমন উৎকন্ঠা, অস্থির। কদিন ধরে বৃষ্টিটাও যা শুরু করেছে! নামছে তো নামছেই। ঢাকায় বৃষ্টি নামা মানে তো আজাব। সবকিছু কেমন এলোমেলো করে দেবে। জলাবদ্ধতা, জ্যাম, লোকজনের হুড়োহুড়ি, কত কি! এখন তো শুরু হয়েছে আবার নতুন উৎপাত! সিটি কর্পোরেশনের লোকেদের রাস্তা খোড়াখুড়ি। সারাবছর কোন খবর নেই, বর্ষার সিজন এলেই এদের খোড়াখুড়ির কাজ-কারবার শুরু হয়ে যায়। ভাঙা রাস্তাগুলি তো মৃত্যুফাঁদ। গারা-গর্তে পানি জমলে বোঝার কোন উপায় নেই গর্তগুলো কত গভীর। বড় গর্তে রিক্সা-ভ্যানের চাকা পড়ল তো গেল। উল্টে পুল্টে একাকার!
একটু বৃষ্টি হলেই রিক্সার বড় আকাল এই ঢাকা শহরে। খালিদ দু একটা রিক্সা যাওবা দেখছে তাও তো এরা আবার যাবে না। জোরাজুরি করেও লাভ নেই। যাবে না তো যাবেই না। কেন যাবে না, কখন যাবে, কোথায় যাবে, এরা আর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। একটু দূ্রেই এক ভদ্রলোক এক রিক্সাঅলাকে ধমক ধামক দিচ্ছিল।তবুও সে অনড়, যাবে না তো যাবেই না। এই লোকগুলোও আছে! কেউ যেতে না চাইলে তাকে জোর করে কোন অধিকারে? রিক্সা শ্রমিকরাও তো এই দেশের নাগরিক। যাওয়া না যাওয়ার অধিকার তাদেরও আছে। মন চাইলে যাবে, না চাইলে যাবে না। এত ধমকানির কি আছে? রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে অগত্যা ছাতা মাথায় হাঁটা দেয় খালিদ।
খালিদের অফিস কলেজগেটের কাছে, হুমায়ুন রোডে। হুমায়ুন রোড হলেও গজনবী রোডের সাথে লাগোয়া। একটা এনজিওতে কাজ করে; গবেষণা সমন্বয়ক। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ-কারবার ওদের এনজিও‘র। বউকে নিয়ে শেখেরটেকের ভাড়া বাসায় থাকে। ছোট্ট বাসা। বিয়ে করেছে প্রায় বছর ছয়েক তো হবেই। সাবিনাও আগে চাকরি করত। হাইপোথাইরয়েডিটি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল একবার। একেবারে সয্যাসায়ী। তারপর থেকে আর চাকরি করে না।ওর এই অসুখের কারণে বাচ্চাও নিতে পারছিল না। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছিল- মা হওয়ার সম্ভাবনা কম। ওরা আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। পালক বাচ্চাও খুঁজেছে অনেকদিন। আল্লাহর অশেষ রহমতে বিয়ের ছয় বছর পর গত তিন মাস আগে কন্সিভ করেছে সাবিনা। বহু কাঙ্খিত স্বপ্ন বাস্তব হতে চলেছে। ডাক্তার সাবিনাকে খুব সাবধানে থাকতে বলেছে। তিনমাস কোন নড়াচড়া করা যাবে না। একেবারে বেডরেস্ট।

।তিন।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে একটা গামছা মুড়ি দিয়ে মাধুরী খালার খুপড়ির কাছে গিয়েই একবার কোমরে হাত দেয় আজগর। লুঙ্গিতে গুজে রাখা টাকাগুলো খুলে হাতে নেয়। গুনে দেখে। বিশ টাকার একটা, দশ টাকার দুইটা, দুই টাকার বেশ কিছু নোট। সব মিলিয়ে বায়ান্ন টাকার মত হবে। এক পুরিয়া শুকনার দাম এখন পঞ্চাশ টাকা। গত দুইদিন আগেও চল্লিশ টাকা ছিল। বৃষ্টি বাদলের দিন মালের কাটতি বেশি। মানুষ এখন টানেও খুব। সেই তুলনায় সাপ্লাই নাই। টাকাগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আজগর। আগের প্রায় আড়াইশ টাকার মত দেনা আছে মাধুরী খালার কাছে। ‘মাল আনতে গেলেই মাগী খ্যাচখ্যাচ করব। কইব- বাকি টাকা দে। মাল নাই। এইডা, হেইডা, আরো কত কী! উহ্! শালার মাল টানতে গিয়াও দুনিয়ার অশান্তি! ভাল্লাগেনা আর!’ একটু ভাবে আজগর। তারপর বস্তির চিকন পথ বেয়ে মাধুরী খালার খুপড়ির দিকে এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে ডাক দেয়,
– খালা ঘরে আছস নিকি? খালা, ও 
-ক্যাডা? আজগইর‌্যা আইছস না?
-হ খালা, আমি।
-ঠিক সমেই আইছস।
খুপড়ির ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে আসে মাধুরী খালা। বলে- ‘ট্যাকা আনছস? আমার বাকি ট্যাকাগুলান?’
ক্ষেপে ওঠে আজগর- তুইও দেহি আমার বাড়িয়ালির লাহান খ্যাচ খ্যাচ করস।কইছি তো দিমু। দ্যাওয়া-দুয়ার মইদ্যে কামাই বালা না। ম্যাঘ-দ্যাওয়া গেলেই আতে ট্যাকা অইব। তহন তর সব ট্যাকাটুকা দিয়া দিমুনে।
-তাইলে আইছস ক্যারে? তর চিটারি স্বভাব বাদ দিয়া বালা ওইয়া যা।
-খালা, মায়ের বইনে আমার, রাগ করিছ না। একটু আধটু মাল-মুল থাকলে দে আমারে। খায়া বাঁচি।
-মাল নাই।
-নাই মানে।
-নাই মানে নাই। কাইল চালান আহে নাইক্ক্যা। মোকামে মাল নাই।
-মিছা কথা কইস না, খালা। আমারে এক পুইরা অইলেও দে। এহনকারডা নগদ দিয়া দিমুনে। এই নে, ধর।
বলেই গুনে গুনে পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে দেয় আজগর।
-এইহানে কত আছে?
-ক্যান? পঞ্চাইশ ট্যাকা।
-পঞ্চাইশ ট্যাকায় অইব না। আরো দশ ট্যাকা দিওন লাগব।
–দশ ট্যাকা দিওন লাগব মানে? কাইলও তো পঞ্চাইশ ট্যাকায় লইলাম। তার আগে তো চল্লিশ ট্যাকাই আছিল।
-কইলাম না, চালান আহে নাইক্ক্যা? মালের দাম বাড়তি এহন।
-ডাকাতি করিসনা কইলাম, খালা। খালি আমগো লগেই পারোস। বড়লোকের পোলা- মাইয়াডি যহন আহে তহণ তো দেহি রা করস না। তুই খালি পারস এই আজগরের লগেই।
তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মাধুরী খালা। বলে,
   – ওই ফহিন্নির পুত। বড়লোকের পোলা-মাইয়ারা কি তর লাহান হুগনার কাস্টমার? হ্যারা বালা বালা জিনিস নিতেই আহে। এহ্! কামাইয়ের মুরোদ নাই, ফইন্নির পোলায় আইছে চোট দেহাইতে। এত চোট তর বউ’র লগে দ্যাহা গা যায়া। এইহানে মরতে আহস ক্যা? যা ভাগ। আমি তর কাছে মাল বেচমু না।
   – খালা, ঘরের বউ নিয়া কথা কইবি না কইলাম। দ্যামাগে লাগে।
   – ওরে আমার দ্যামাগঅলা রে! ছাল নাই কুত্তার, নাম থুইছে বাঘা। ফহিন্নির পোলা, তার আবার দ্যামাগ! যা ভাগ! 
বলেই টাকাগুলো আজগরের মুখের দিকে ছুড়ে ফেলে মাধুরী খালা। আজগর এবার কিছুটা নরম হয়। মাটি থেকে টাকাগুলো তুলে মাধুরী খালার হাতে গুজে দেয়। বেশ কাকুতি মিনতি করে,
-খালা, মা আমার। এইবারের মতন ক্ষ্যামা দে। টাকাগুলান রাখ, আমারে এক পুইরা মাল দে। কসম কইরা কইতাছি, কাইলই তর বাকি টাকা আমি দিয়া দিমু।
মাধুরী খালাও এবার কিছুটা নরম হয়। ঘরে যেতে যেতে বলে- খাড়া এইহানে। বলেই ঘরে যায়। কাগজে মোড়ানো ছোট্ট একটা গাঁজার পুরিয়া এনে আজগরের হাতে দেয়। বলে- ল। আর হুন, বস্তির আশপাশে কইলাম ধরাইবি না। দূরে গিয়া খাইবি। সরকারি লোক খুব জ্বালাইতাছে।
-‘আইচ্ছা।’ বলেই গাঁজার পুরিয়াটা হাতে নিয়ে হন হন করে বের হয়ে যায় আজগর।

।চার।

হুমায়ুন রোডে ফিরে না গিয়ে বরং গজনবী রোড দিয়েই হাঁটা ধরে খালিদ। সামনে যদি রিক্সা-টিক্সা কিছু পাওয়া যায় এই ভেবে। বৃষ্টিতে এবার বেশ ভেঙেচুড়ে গেছে রাস্তাটি। এ রাস্তা দিয়েই বাসা টু অফিস যাতাযাত করে ও। ভেতরে রিক্সা পাওয়া বেশ দুষ্কর। তাই এগিয়ে এসে গজনবী রোডের মাথা থেকেই রিক্সা নিতে হয় রোজ। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় খুব সতর্ক হয়ে হাঁটে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটারও জো নেই। জায়গায় জায়গায় কাঁদার স্তুপ। রাস্তার জায়গায় জায়গায়ও গর্ত। গর্তগুলোতে বৃষ্টির পানি জমে টাইটুম্বুর। বড়লোকের ছিঁচকে ছেলেগুলি ক্ষ্যাপাটে হয়ে পানিভর্তি গর্তের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলেই সারে সর্বনাশ! কাঁদাপানি দিয়ে নাইয়ে ওঠা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। ভয়ে ভয়ে হাঁটে খালিদ।  হাঁটে আর ভাবে। গত ক’বছরে হঠাৎ করেই এদেশে বড়লোকের সংখ্যা বেশ বেড়েছে। শিল্পায়ন হয়েছে, কৃষিতেও বিপ্লব হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, দেশ উন্নত হচ্ছে, সে তুলনায় শ্রমিক অধিকার পুরোপুরি রক্ষিত হচ্ছে না। বড়লোকেরা যে গতিতে আরো বেশি বড়লোক হচ্ছে, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনমানের কিছুটা পরিবর্তন হলেও এদের উন্নতির গতি আনুপাতিক হারে বড়লোকের তুলনায় বেশ মন্থর। গত দুই দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন সূচকের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হলেও একটা বিশেষ শ্রেণীই এর সুবিধাটা নিচ্ছে বেশি। তবুও বড় আশার কথা, ১৯৯০ সালের দিকে প্রায় সাতান্ন শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করলেও ‘৯০ এর পর থেকে ধীরে ধীরে তা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে দারিদ্র্যের হার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। মানুষের ভাতের কষ্ট হয়ত আর নেই তবুও প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য এখনও পুরোপুরি ফেরেনি এই বাংলাদেশে। 
গত কয়েক বছরের চাকরির সুবাদে এদেশের খেঁটে খাওয়া শ্রমিক-মজুরদের জীবনযাত্রা, জীবনমান, শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি সরকারি-বেসরকারি, কোম্পানি কিংবা ব্যক্তি মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গি, শ্রমিক অধিকার, মানবাধিকার নিয়ে খালিদের গবেষণা করতে হয়েছে বিস্তর। গবেষণা করতে গিয়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষের করুণ অবস্থা সুক্ষভাবে বেশ কাছ থেকেই দেখার সুযোগ হয়েছে। এ কারণে এইসব মানুষের প্রতি দরদ ও সহানুভূতি জন্ম নিয়েছে ওর মনে। ভালবাসা ও সমবেদনাও জন্ম নিয়েছে। ছাত্রাবস্থায়ও এসব বিষয়ে পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখি করেছে ও। করেছে স্রেফ নেশা থেকেই। লেখালেখির নেশা অবশ্য ছোটবেলা থেকেই। এসব কারণেই এই ধরণের চাকরিতে আসা। অন্য কোথাও চেষ্টা করেনি। এতদিন ধরে এখানেই মাটি কামড়ে পড়ে আছে। চাকরিটা খুব একটা খারাপ লাগে না খালিদের। বলা যায়, ভালই লাগে। ভাল লাগার আরেকটা কারণ বোধ হয়, শরীফ ভাইয়ের মার্জিত ও বন্ধুবাৎসল ব্যবহার। ড. শরীফ আমান চৌধুরী। বিদ্বান লোক। খালিদের বস। এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। ছোটখাটো হলেও এনজিও’টির বেশ নাম ডাক। আন্তর্জাতিক বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে ওদের গবেষণার বেশ গ্রহণযোগ্যতাও আছে। ধৈর্য্য আছে লোকটার, সৎ-ও বেশ। তবে কিছুটা খামখেয়োলি কিসিমের। মানুষটা কিন্তু মন্দ না। খালিদকে বেশ স্নেহ করে শরীফ ভাই; বিশ্বাসও করে। পদে কো-অর্ডিনেটর হলেও, ভাই দেশে না থাকলে খালিদকেই ছায়া পরিচালকের কাজটি করতে হয়। আহারে! বেচারা শরীফ ভাই! সংসরাটা আর করা হল না এ জীবনে! সারাজীবন এদেশ ওদেশ করেই কাটিয়ে দিতে হল।
বৃষ্টি কিছুটা কমেছে এখন। গুড়ি গুড়ি পড়ছে। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় ছাতা ধরে হাঁটে খালিদ। হাঁটে আর ভাবে। গত দুই দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যেকোনো সূচকের বিচারে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হলেও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান খুব বেশি উন্নত হয়নি। একজন গার্মেন্টস কর্মী যে পরিমাণে শ্রম দেয়, সে পরিমাণে পারিশ্রমিক পায় না। আন্তর্জাতিকমানের বেশ কিছু দেশী-বিদেশী গার্মেন্টস কোম্পানি শ্রমিক অধিকারের প্রতি বেশ যত্নশীল হলেও তা আর কয়টা? অগণিত উঠতি লোকাল গার্মেন্টস কোম্পানিগুলোতে শ্রমিক অধিকার ততটা রক্ষিত হয় না। অথচ এইসকল খেটে খাওযা মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রমকে পুঁজি করে রাতারাতি বড়লোক বনে যাচ্ছে এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। শ্রমিকরা তো কর্মক্ষেত্রে ঢোকার সাথে সাথেই ফ্যাক্টরির তালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর এই তালা ততক্ষণ খোলা হয় না যতক্ষণ না মালিকপক্ষ চায় শ্রমিকরা এবার বাড়ি যাক। আট ঘন্টার কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে কেউ চাক বা না চাক ওভারটাইম এর কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী কোম্পানি কেবল শ্রমিকদের ওভারটাইম করার প্রস্তাব দিতে পারে, করবে কি করবে না তা একান্তই শ্রমিকদের নিজস্ব ব্যাপার। বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। নামমাত্র শ্রমমূল্যে এদেরকে দিনের পর দিন নির্ধারিত কাজের অতিরিক্ত কাজ চালিয়ে যেতে হয়। ভেজা, স্যাঁতসেতে ছোট ছোট ঘর ভাড়া করে থাকতে হয় এদের। সারাদিনের প্রচন্ড পরিশ্রম শেষে জোটে না পুষ্টিকর কোন খাবার। বেতনাদি যা পায় কোনমতে নিজে চলে অভাবের সংসারে পাঠাতে হয় টাকা। পেটে-ভাতে বেঁচে থাকে এইসব পরিশ্রমী মানুষগুলো। দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির ছিটোফোটা প্রভাবও এদেরেকে স্পর্শ করে না। এদের জীবনমানের কোন উন্নতি হয় না। পরিশ্রম অনুসারে যতটুকু বিশ্রাম নেয়া দরকার, তাও নিতে পারে না। কাজ থেকে ফিরে বাজার-ঘাট করে, রান্না-বান্না শেষে খেয়ে দেয়েই প্রচন্ড ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে ঘুমে। ক্লান্তি ফুরোতে না ফুরোতেই আবার ছুটতে হয় কাজে। এরা যেন মেশিন। নিঃস্বাস নেবার সময় কোথায়?
দেশের ৭২ শতাংশ পোষাকশ্রমিকই নারী। এরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পেলেও পায় না কোন বিশেষ ভাতা। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি নারীকে মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য ২৫ হাজার টাকা করে ভাতা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। ভাতা তো দূরে থাক ছুটিতে থাকায় মূল বেতনই তো পায় না। ফলে মাতৃত্বকালীন সময়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে এদের। মা, শিশু সবার শরীরেই বাসা বাঁধে অপুষ্টিজনিত নানান ব্যাধি।
গজনবী রোডের শেষমাথায় শাহজাহান রোড দিয়ে জেনেভা ক্যাম্প পার হয় খালিদ। হুমায়ুন রোড ধরে রিং রোডের দিকে হাঁটা দেয়। রিং রোড পার হয়ে আর কিছুদূর হাঁটলেই ওদের বাসা। হাঁটে আর ভাবে খালিদ। প্রায় আশি লাখ প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো আয়, তৈরি পোশাক খাতের প্রায় চল্লিশ লাখ শ্রমিক এবং কৃষির সবুজ বিপ্লব বা এক জমিতে দুই ফসল দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রগতি অর্জনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। তবুও গ্রাম বা শহরের একটা বিশেষ শ্রেণী এখনও সচ্ছল হতে পারেনি। বড় বড় শহর ও শহরতলিতে এখনও হাজারো মানুষ গৃহহীন। রাস্তার পাশে ফুটপাতে, পার্কে, এখানে ওখানে ভাসমান মানুষের অবস্থান। ঝড় বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে কিংবা খরা রোদে পুড়ে পুড়ে কাটছে তাদের দিনরাত। সর্বগ্রাসী নদী ভিটে-মাটি সব কেড়ে নিয়েছে কিংবা  বিভিন্ন কারণে গাঁয়ের বহু বছরের আবাস থেকে বিতাড়িত হয়ে নতুন করে বাঁচার আশায় বুক বেঁধে আগমন এই ভীড়ের নগরে। শহরে কাজ মিলবে, মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে- এতটুকুই তো আশা! কুলি, মজুর, রিক্সা শ্রমিক, ফেরিঅলা, ভিখারী, ভবঘুরে এসব মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয় বড় শহরগুলোতে। বিনে পয়সায় রাস্তাঘাটে কিংবা কম পয়সায় বস্তির খুপড়িতে এক কাতে শোয়ার ব্যবস্থা হয় ঠিকই কিন্তু দেশের চলমান প্রগতি এদের জীবনমানে কোন প্রভাব ফেলে না।          
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে ধমক খাওয়া সেই রিক্সাঅলাটির কথাও একবার মনে আসে খালিদের। বৃষ্টির মধ্যে যাবে না বলে রিক্সাঅলাকে খামোখা ধমকাচ্ছিল লোকটি। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এই এক স্বভাব। খালি নিজেরটাই বোঝে। সারাদিন ঘামে ভিজে রিক্সা চালিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে না চাওয়ার পেছনে হাজারটা কারণ থাকতে পারে। এরা তো দিন আনে দিন খায়। বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ করলে কাজে যাবে কে? বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়েই থাকতে হবে। আপনি তো মশাই চাকরি বাকরি করেন। অসুখ বিসুখ হলে ছুটি-ছাটা নিতে পারবেন। এজন্য আপনার বেতনও বন্ধ হবে না, পরিবারও না খেয়ে থাকবে না। তাছাড়া আপনি তো সারাদিন এয়ারকন্ডিশনেই থাকেন। রোদ-তাপ কিংবা ভ্যাপসা গরম আপনাকে ছুঁতে পারে না। রিক্সাঅলারা তো দিনের পর দিন ঘাম-গরমের মধ্যেই কাটায়। বৃষ্টির ভয়েই হয়ত কাচুমাচু হয়ে আশ্রয় নিয়েছে রিক্সার ছাউনির নিচে। রিক্সাঅলার অসুখ হলে কি হাল হবে? এ কথা তো একবার ভাবলেন না, মশাই। রাস্তার মোড়ে রিক্সাঅলাকে ধমকানো সেই লোকটার উপর মনে মনে খেদ ঝাড়ে খালিদ। ভাবে- এই শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি এদেশের উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কারোরই কোন সম্মানবোধ নেই। রেঁস্তোরার বয়, রিক্সাঅলা, বাসঅলা, ফেরিঅলা যেই হোক না কেন, পান থেকে চুন খসলেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে, গায়ে হাত তুলতে কারোরই বিবেকে বাঁধে না। যেন এটাই নিয়ম! কি সম্বোধন, কি ব্যবহার, সবদিক দিয়েই এদেরেকে অবজ্ঞা করাই যেন রীতি! যেন ঘৃনা, অপমান, অবজ্ঞা পাওয়ার জন্যই এদের জন্ম!

।পাঁচ।

বাসার কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দেয় সাবিনা। ও মনে হয় দরজা খোলার জন্য রেডি হয়েই ছিল। অপেক্ষা করছিল হয়ত অনেকক্ষণ ধরে। বাইরের দরজার আশপাশেই পায়চারি করছিল হয়ত। এজন্য মুহূর্তের মধ্যেই খুলে দিয়েছে দরজা। আজকাল তো ফোন করলেও রিং হওয়ার সুযোগ দেয় না সাবিনা। সাথে সাথেই ধরে ফেলে। মনে হয় ফোনটা হাতের মধ্যেই রাখে। খালিদকে ঘন ঘন ফোন করলেও হয়ত সারাক্ষণই ফোন করার ইচ্ছা হয়। অফিসের কাজের সমস্যা হবে ভেবে হয়ত আর করে না। কন্সিভ করার পর থেকে বেশ রোগা হয়ে পড়েছে সাবিনা। খেতে পারে না কিছুই। বুঝিয়ে শুনিয়ে একটু আধটু খাওয়ালেও খুব একটা লাভ হয় না। বমি করে সব উগরে দেয়। ওর জন্য খুব চিন্তা হয় খালিদের। থাইরয়েডের অসুখ আবার বেড়ে গেল কি না কে জানে। মাপারও তো সময় হয়ে এলো আবার। ওষুধ ঠিকমত খাচ্ছে তো? প্রতিদিন সকালে পঞ্চাশ পাওয়ারের দুইটা করে থাইরক্সিন খেতে হয় খালি পেটে। এভাবে কতদিন যে খেতে হবে আল্লাহই ভাল জানেন। ডাক্তার তো বলল নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। সারাজীবনও খেতে হতে পারে। সেবার হাইপোথাইরয়েডিটি খুব বেড়ে গিয়ে যখন সয্যাসায়ী হয়েছিল, শরীরটা একেবারে কঙ্কালসার হয়ে পড়েছিল সাবিনার। সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মেডিসিনের এক ডাক্তার দেখাচ্ছিল অনেকদিন। ওষুধও খাচ্ছিল। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। হয়ত ঠিক ডাক্তারের কাছে যেতে পারেনি ওরা। সাবিনার ভীষণ চুল উঠত। সব সময় ক্লান্তি ও অবসাদে মনটা বিষন্ন হয়ে থাকত। শীত শীত লাগত আর বুক ধড়ফড় করত। ক্রমাগত ওজন কমে যাচ্ছিল। ঘুম হত না। মাসিকও নিয়মিত ছিল না। কাজে-কর্মে একেবারেই অমনোযোগী হয়ে উঠছিল ও। অবশেষে খালিদ ওর এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে রক্তের টিএসএইচ, এফটিফোর পরীক্ষা করেই নিশ্চিত হওয়া গেছে ওর হাইপোথাইরয়েডিটি। এ রোগ যদিও অতটা জটিল কিছু নয় তবে সময়মত নির্ণীত না হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। ডাক্তারদের মতে, এ রোগ হল এক ধরণের হরমোনাল ডিসফাংশন। মানুষের গলার কাছে থাইরয়েড নামক এক ধরণের ছোট্ট গ্রন্থি থাকে যা থেকে শরীরের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় হরমোন নিসৃত হয়। একে বলে থাইরয়েড গ্রন্থি। অঙ্গটি ছোট হলেও এর কাজ অনেক। থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতায় সমস্যা থাকলে মেয়েদের গর্ভধারণে সমস্যাসহ নানাবিধ জটিলতা তৈরি হয়। গর্ভাবস্থায় বাচ্চার মস্তিস্কসহ অন্যান্য অঙ্গ গঠনে থাইরয়েড গ্রন্থির বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সমস্যাযুক্ত থাইরয়েড নিয়ে গর্ভধারণ করলে ত্রুটিপূর্ণ নবজাতকের জন্ম হতে পারে। এই থাইরয়েড  গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি হরমোন নিসৃত হলেই তা থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ বলে বিবেচিত হয়। হরমোন বেশি নিসৃত হলে তাকে বলে হাইপোথাইরয়েডিজম আর কম হলে বলে হাইপারথাইরয়েডিজম। এ রোগ কেবল মেয়েদের নয়, পুরুষদের এমনকি শিশুদেরও হয়। বংশ পরম্পরায়ও এ রোগ হতে পারে। অনেকটা ডায়াবেটিসের মতই। থাইরয়েডের অসুখ হলে মানুষ যে কেবল রোগা হয় তা কিন্তু নয়। রোগা হতে পারে, আবার মুটিয়েও যেতে পারে। তবে এ অসুখের কারণে বেশিরভাগ মানুষই হঠাৎ করে ভীষণ মুটিয়ে যায় ও দূর্বল হয়। অনেক মানুষের স্থুলতার কারণ যে থাইরয়েডের অসুখ তারা তা জানে না। এ রোগের ডাক্তারদেরকে বলা হয় এন্ড্রোকাইনোলজিস্ট। থাইরয়েড গ্রন্থি যে মানবদেহের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ সাবিনার এ অসুখ না হলে খালিদ হয়ত কোনদিনই জানতে পারত না। ওর অবশ্য ডাক্তারি বিষয়ের প্রতি আগে তেমন আগ্রহও ছিল না। এখন বুঝেছে, কিছু কিছু বিষয় সাধারণেরও জানা থাকা দরকার।
-এত তাড়াতাড়ি দরজা খুললা যে। কাছেই ছিলা নাকি?
-হুম। কখন থেকে অপেক্ষা করতিছি। এত দেরি হল কেন, তোমার?
-আর বইলো না। বৃষ্টির মধ্যে রিক্সা নাই। হেঁটেই আসতে হইল।
খালিদের হাত থেকে ব্যাগ আর ছাতা নেয় সাবিনা। ওগুলো রাখতে রাখতে বলে- ফ্রেস হয়ে নাও। নাশতা দিচ্ছি। তোমার জন্য আজ চপ বানাইছি, ছোলা ভুনাইছি। গরম থাকতে থাকতে মুড়ি দিয়ে খেয়ে নাও।
-‘এই- যে! এই শরীর নিয়ে তোমাকে এগুলো করতে কে বলছে?’ জুতা খুলতে খুলতে বলে খালিদ।
-এমনিই করছি।
-এমনিই করছি মানে? শরীরের অবস্থা দেখতে হবে না?
কিছু বলে না সাবিনা। পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে খালিদকে। খালিদ বলে,
-সকালে ওষুধ খাইছিলা?
-‘খাইছি।’ কিছুটা আহ্লাদী স্বরে বলে সাবিনা।
-ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছ তো, সোনা?
-হুম।
-খবরদার, ভুল কইরো না কিন্তু! ওষুধটা নিয়মিত খাইয়ো।
-‘ওষুধ খাইতে আমার তো আর ভাল্লাগে না, সোনা।’ সাবিনার আহ্লাদী স্বর আরো একটু প্রকট হয়ে আসে।
-‘ভাল না লাগলেও খাইতে হবে, সোনাপাখি।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে সাবিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে খালিদ।‘অন্তত আমাদের সোনাবাবুটার ভাল’র জন্য।’
খালিদকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সাবিনা। খালিদ আলতো করে সাবিনার কপালে একটা চুমু দেয়। বলে- ‘এবার ছাড়ো, জান। আমার শরীরে ঘাম। ফ্রেস হয়ে নেই?’
-‘না, ছাড়ব না।’ বলেই আবার শক্ত করে ধরে সাবিনা। তারপর অল্প কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থেকে ছেড়ে দিয়ে বলে- যাও, ফ্রেস হও। আমি নাশতা দেই।’
লুঙ্গি পরে, ফ্রেস হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় খালিদ। উহ্! কয়দিন ধরে যা ধকল যাচ্ছে! শরীফ ভাই দেশে নেই। যাবতীয় কাজকর্ম ওকেই সামলাতে হচ্ছে। দুইজনের কাজ একজনেই সামলাচ্ছে আর কি! কাল তো আবার সেমিনার আছে। একটা রাইট-আপ দাঁড় করানো দরকার। কিছু একটা তো বলতে হবেই। রাতে একটু বসতে হবে। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে যা ভেবেছে তার মধ্য থেকেই কিছু একটা রেডি করে নেবে ভাবছে। অফিস থেকে বেশ কিছু রেফারেন্স বইও নিয়ে এসেছে। বাসায়ও কিছু আছে।
-‘ডাইনিং-এ বসবা? নাকি ওখানেই নিয়ে আসব?’ ডাইনিং রুম থেকে জিজ্ঞেস করে সাবিনা।
-আনো। এখানেই আনো।
-আচ্ছা।
প্লেটে করে নাশতা আর হাতে করে একগ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসে দিয়ে যায় সাবিনা। ফিরে গিয়ে আবার পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে এসে খাটের সাইড-টেবিলের উপর নামায়। খালিদ এক চুমুকে শরবতটুকু শেষ করে। ছোলা মুড়ি মাখাতে মাখাতে বলে,
-খাইছো কিছু?
-বিকেলের দিকে একটু ভাত খাইছি।
-ভাল করছ। বমি-টমি হয় নাই তো আবার?
-হবো হবো করতেছিল। পরে আর হয় নাই।
-যাক ভাল। এখন এখানে বস, আমার সাথে কিছু একটা খাও।
-‘না। ইচ্ছা করতেছে না।’ তারপর কি একটা মনে করে বলে- ‘আচ্ছা, দাঁড়াও।’
বলেই ফ্রিজ থেকে একটা আপেল বের করে পিরিচে করে কেটে নিয়ে আসে সাবিনা। সাইড টেবিলের এক কোণায় রাখে। এক টুকরো নিয়ে চিবোতে থাকে। একটু ছোলা-মুড়ি মুখে দেয় খালিদ। খেতে খেতে বলে,
-বুয়া আসছিল?
-হুম। রাতে তোমাকে খিঁচুড়ি আর গরুর মাংস খাওয়াবো।
-তাই নাকি? বুয়া রাঁধছে বুঝি?
-আমি রাঁধছি।
-তুমি রাঁধছ মানে কি? তোমাকে না এখন রান্না-বান্না করতে নিষেধ করছি? কেন করছ?
-বাটা ঘষা, কাটাকুটি সব বুয়াই করছে। আমি শুধু রান্নাই করছি।
-তা-ও করবা না।
-আচ্ছা করব না। এখন চুপচাপ খাও তো।
খেতে থাকে খালিদ। খেতে খেতে আবার বলে,
-মা’র সাথে কথা হইছে?
-হুম হইছে। আম্মার প্রেসারটা মনে হয় আবার বাড়ছে।
-বল কি! আমার ফোনটা দাও দেখি। ওয়্যারড্রোব এর উপরে রাখছি মনে হয়।
-আচ্ছা খেয়ে নাও না। আব্বার সাথেও একটু আগেই কথা হইছে। সমস্যা নাই, আম্মা এখন ভালই আছে। খেয়ে পরে কথা বইলো। আচ্ছা শোন- তুমি খেতে থাক। আমি নামাযটা পড়ে নিই।
-আচ্ছা, যাও। দেইখো, সাবধানে রুকু-সিজদা দিও। পেটে যেন প্রেসার লাগে না আবার।
-টুলে বসে পড়ি তো।
-গুড। যাও, নামায পড়। ওহ্, ভাল কথা, তোমার টেস্টগুলো করাতে কাল কখন যেতে হবে যেন?
-বিকেলে গেলেও হবে।
-ডাক্তারের সিরিয়াল কখন?
-সন্ধ্যায়।
-ওকে, ফাইন। কাল আমাকে একটা সেমিনারে অ্যাটেন্ড করতে হবে, প্রেসসক্লাবে। তুমি রেডি হয়ে থাইকো। আমি বিকেলের মধ্যেই ফিরব।
-ঠিক আছে।

।ছয়।

বৃষ্টি হচ্ছে খুব। এর মধ্যে সাবিনাকে নিয়ে হাসপাতালে কিভাবে যাবে বুঝতে পারছে না খালিদ। আজ বাদ দিয়ে কাল যাওয়ারও তো উপায় নেই। ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়া বেশ দুষ্কর। একবার ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে কবে যে আবার সিরিয়াল পাবে তার কোন ভরসা নেই এই সব নামী ডাক্তারদের ক্ষেত্রে। তাছাড়া আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে হবে ডাক্তার দেখানোর আগে, থাইরয়েডের টেস্টও আছে। আগে করিয়ে রাখলে ভাল হত কিন্তু সাবিনাকে নিয়ে বার বার টানাটানি করতে সাহস হচ্ছিল না খালিদের। তাই টেস্ট আর ডাক্তার দেখানো একবারই সারতে চেয়েছিল। আপাতত আলট্রাসনোগ্রাফিটাই দেখাবে। পরে থাইরয়েডের রিপোর্ট হাতে পেলে খালিদ একা গেলেও চলবে, সাবিনাকে নিতে হবে না।
আরো আগে রওনা দিলে ভাল হত হয়ত। এত তাড়াহুড়ো থাকত না কিন্তু রাস্তার জ্যামই তো যত নষ্টের মূল। খুব বিরক্ত লাগছে খালিদের। প্রেস ক্লাব থেকে মোহাম্মদপুর আসতে প্রায় আড়াই ঘন্টা লেগেছে। গত কয়েক বছরে অসহনীয় মাত্রায় গাড়ি বেড়েছে ঢাকার রাস্তায়। ধারণক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত গাড়ি, রাস্তা দখল করে হাট-বাজার, প্রাইভেট কারের আধিক্য, অপরিকল্পিত সিগন্যাল, এগুলোই বোধ হয় জ্যামের প্রধান কারণ। এছাড়া গ্রাম ও মফস্বল থেকে ক্রমাগত ঢাকামুখী মানুষের যাত্রা জ্যামের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তুলছে দিনে দিনে। নতুন নতুন মানুষ আসছে, নতুন নতুন গাড়ি নামছে, সে তুলনায় রাস্তা তো বাড়ছে না। বেশ কিছু উড়াল সড়ক হলেও তার সুবিধা পেতে না পেতেই তৈরি হচ্ছে নতুন আবাসন, শহর। উড়াল সড়ক নামক ছিদ্র দিয়ে আরো বেশি মানুষের ঢল নামছে এখানে। ঢাকা কেন্দ্রিক অফিস-আদালত, কল-কারখানা বাড়ছে, তাই মানুষও বাড়ছে। ঢাকা বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। তবুও যতটুকু বাড়ছে সে তুলনায় আরো বেশি মানুষ আসছে। প্রয়োজনের কারণেই একই স্থানেই বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষ। মতিঝিল, গুলিস্তান, সচিবালয়, শাহবাগ, মালিবাগ, মহাখালি, বনানী, গুলশান, উত্তরা, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, শ্যামলী, আগারগাও, মিরপুর। যেখানেই থাকুক, ঘুরে ফিরে বার বার এ জায়গাগুলোতেই কিংবা এর আশপাশেই চর্কির মত ঘুরতে থাকে মানুষগুলো। ব্যবসায়িক, দাপ্তরিক, কর্মক্ষেত্র কিংবা কেনাকাটা যে কারণেই হোক মানুষ এখানেই কিংবা এর আশপাশেই আসে। আসতে বাধ্য হয়। মানুষের এত চাপ আর নিতে পারছে না এই তিলোত্তমা নগরী ঢাকা।
এই রাজধানী ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য পক্ষে বিপক্ষে কথা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। মানুষকে যেন বেশি বেশি রাজধানী ঢাকামূখী না হতে হয় তার জন্য জল্পনা-কল্পনাও কম হয়নি। ঢাকামুখী জনস্রোত ঠেকানোর জন্য অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমার সদর দফতর কিংবা এ ধরণের বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষকে আসতে হয় প্রতিনিয়ত, পরিকল্পিতভাবে সে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে কিছু কিছু ঢাকার বাইরে স্থানান্তরের কিংবা দপ্তরগুলোর কর্তাব্যক্তিদের প্রশাসনিক ক্ষমতা এক স্থানে পুঞ্জিভূত না রেখে বন্টনের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা নিয়েও কম আলোচনা হয়নি কিন্তু নানাবিধ কারণে তা আর সম্ভব হল কোথায়? তবুও প্রযুক্তির এ যুগে নতুন করে ভাবতে দোষ নেই। এখন তো দেশের প্রায় সব জায়গাতেই ইন্টারনেট আছে, টেলিফোন কিংবা মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক আছে। আজকাল তো ইমেইলের মাধ্যমে মূহুর্তের মধ্যে চিঠিপত্র, ফাইল-ডকুমেন্টস আদান প্রদান করা যায়। ভিডিও কন্ফারেন্সের মাধ্যমে সভা কিংবা মিটিংও করা যায়। সকল প্রতিষ্ঠানের হেড কোয়ার্টার কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সকল প্রশাসনিক দপ্তরকে ঢাকার আশপাশে কোথাও সরিয়ে নিয়ে সেখানেও নতুন করে প্রশাসনিক শহর স্থাপন করা যায়।     
এই ছোট্ট বাংলাদেশে বিশেষায়িত শহরের কথাও ভাবা যেতে পারে। শিল্প কিংবা সেবার ক্ষেত্রে উৎপাদনের সুবিধা, যোগাযোগ কিংবা পরিবহনের সুবিধা বিবেচনায় এক একটি শিল্প কিংবা সেবার চারণক্ষেত্র এক একটি জেলায় স্থাপন করা যেতে পারে। সম্পৃক্ততা কিংবা প্রয়োজন অনুয়ায়ী মানুষ কোন একটি বিশেষায়িত শহরে যাবে, থাকবে। আমাদের দেশে কি চিকিৎসা, কি দাপ্তরিক কাজ অথবা অন্যান্য যে কোন কাজে বা সেবায় যে প্রয়োজনই হোক শেষ পর্যন্ত মানুষকে ছুটতে হয় এই ঢাকাতেই। শিল্প কারখানার জন্য শিল্প শহর, চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা শহর, প্রযুক্তির জন্য প্রযুক্তির শহর, প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজের জন্য প্রশাসনিক শহর এরকম করেও ভাবা যায়। পাবলিক, প্রাইভেট মিলিয়ে ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও তো কম নয়। এখানে যারা পড়ে, তারা অধিকাংশই গ্রাম বা মফস্বল শহর থেকে আসে। সেই হল-হোস্টেল, মেস-বাসা ভাড়া করেই তো থাকতে হয়। কোন একটি নির্দিষ্ট শহরে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্থানান্তরিত কর যেত, তবে তো সে স্থান বিদ্যা শিক্ষার পীঠস্থান হয়ে উঠত। পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ আর তাঁদের ছাত্র-শিষ্যদের নিয়ে জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শণ চর্চার এক মহামিলনমেলা হয়ে উঠত সে শহর। এভাবে চিকিৎসার জন্য, শিল্প-কারখানা এবং অন্যান্য বিষয়ের জন্যেও আলাদা আলাদা প্রসিদ্ধ শহর স্থাপিত হতে পারে। এতে করে উন্নয়নের সুষম বন্টণও নিশ্চিত হবে। কোন বিশেষ শহর প্রতিষ্ঠার জন্য তার সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোসমূহ স্ব স্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত হলেই তা সম্ভব। এর জন্য অবশ্য রাষ্ট্রেীয় তহবিলে অনেক অর্থ কড়িরও দরকার। দরকার পরিকল্পনা। নতুন করে যা যা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সেগুলো যদি এরকম দূরদর্শী চিন্তা ও পরিকল্পনা মাথায় রেখে করা যায়, তাতেও হয়ত কিছুটা ভাল হবে।
ভাবনার ঘোরটা একটু বাঁকিয়ে নিজের দিকে নেয় খালিদ। ভাবে- একদিন হয়ত এভাবে সব হবে। সেদিনটা হয়ত দেখে যেতে পারবে না। তবুও ওর আগত সন্তান অথবা তার সন্তান কিংবা তার সন্তানরা হয়ত দেখবে। একদিন সব কিছুই হবে এই বাংলাদেশে। মানুষগুলো সব শিক্ষিত হবে, ধর্ম ব্যবসায়ীরা থাকবে না, ভন্ড সেক্যুলাররাও থাকবে না। দুর্ণীতি, শোষন থাকবে না, সুবিধাবাদীরাও কমে যাবে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় সীমার ধারণা বিলুপ্ত হবে, থাকলেও সমতা আর সম্প্রীতির এক সংসার বসবে এই পৃথিবীতে। সমস্ত পৃথিবী ক্রমাগত একটিমাত্র বড় রাষ্ট্র হয়ে উঠবে। এসব কথা ভেবে ভেবে আশায় চোখ দুটো চক চক করে ওঠে খালিদের।
-‘বাইরে যা বৃষ্টি! কিভাবে যে যাব সেটাই ভাবতিছি।’ সাবিনাকে বলে খালিদ।
-‘দেখ তো বাইরে সিএনজি বা রিক্সা পাওয়া যায় কিনা?’ বলে সাবিনা।
সাবিনাকে গ্যারেজে রাখা গার্ড এর চেয়ারে বসিয়ে রেখে ছাতা নিয়ে বাইরে যায় খালিদ। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কিছু নেই। একটু এগুলেই একটা রিক্সা পায় খালিদ।
-এই রিক্সাঅলা ভাই, যাবেন।
-কই যাইবেন, স্যার?
-কলেজ গেট।
-যামু, তয় বৃষ্টির মইদ্যে ভাড়া বাড়ায়া দেওন লাগব।
-কত চান?
-আশি ট্যাকা।
-ষাইট টাকায় যাবেন।
-না স্যার, যামু না।
-আচ্ছা ঠিক আছে। একটু পিছনে যেতে হবে। ওখানে আরেকজন আছে।
বলেই রিক্সাঅলাকে দেখিয়ে বাসার কাছে নিয়ে যায় খালিদ। ওরা রিক্সায় উঠে পলিথিনের পর্দা টাঙিয়ে দেয়। খালিদ বলে,
-কি নাম ভাই আপনার?
-আমার নাম আজগর। আজগর আলী মন্ডল।
-ভাল। শোনেন আজগর ভাই, ম্যাডাম একটু অসুস্থ। সাবধানে চালায়েন। দেইখেন ঝাঁকিটাকি যেন না লাগে।
-স্যার, রাস্তাঘাটের যা অবস্থা। তবুও যট্টুক সাবধানে যাওন যায়, চ্যাস্টা করুম।
-ঠিক আছে।
রিক্সা রিং রোড পার হয়ে হুমায়ুন রোড দিয়ে এগুতে থাকে। সাবিনাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে আজ।
-দোয়া কইরো রিপোর্ট যেন ভাল হয়।
-অবশ্যই ভাল হবে, সোনা।
-আমার খুব ভয় করতেছে!
-ভয়ের কিছু নাই। তুমি দেইখো, রিপোর্ট খুব ভাল হবে।
-তাই যেন হয়।
ভয়ে কিছুটা কুঁকড়ে গেছে সাবিনা। খালিদের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকে ও। খালিদও কিছুটা চিন্তিত হয়। মনে মনে বলে, ‘আল্লাহ তুমি রহম কইরো। রিপোর্ট যেন ভাল হয়।’

।সাত।

বৃষ্টি এখন কিছুটা থেমেছে। গুড়ি গুড়ি পড়ছে। জেনেভা ক্যাম্প পার হয়ে শাহজাহান রোড ধরে গজনবী রোডে ঢোকে আজগর। রাস্তাটি বেশ ভাঙা। তার ওপর আবার দুপাশে কাটা। পানি জমে বোঝার উপায় নেই কি পরিমানে গভীর এই কাটা গর্তগুলো। গতকালও এতটা ভাঙা ছিল না। কাল থেকে অনবরত বৃষ্টিতে একদিনের মধ্যেই রাস্তার এই হাল হয়েছে। মাঝে মাঝেই বেশ বড় বড় গর্ত। গর্ত কাটিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে থাকে আজগর। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। কোমরে গুজে রাখা ফোনে একবার হাত দেয় ও। বৃষ্টিতে ভিজে যাবে ভেবে হয়ত ফোনটা ধরে না। চলতি পথে কোমর থেকে ফোন বের করাও দুষ্কর। কিছুটা চিন্তিত হয় ও। সকাল থেকে বউটার শরীর বেশি ভাল না। কি হল আবার কে জানে। একটু পর আবার ফোন বেজে ওঠে। এইবার রিক্সা সাইড করে দাঁড়ায় সে।
-স্যার, বাসার জরুলি ফোন মনে অয়। ধরুম?
-ভেজা শরীরে বৃষ্টির মধ্যে ফোন কিভাবে ধরবেন?
-পলিতিন আছে। কায়দা কইরা ছাপায়া ধরুম।
-আচ্ছা, ধরেন।
ভেজা লুঙ্গিতে গুজে রাখা ছোট পলিথিনের ব্যাগে মোড়ানো মোবাইল ফোন বের করে আজগর। ততক্ষণে রিং বন্ধ হয়ে গেছে। বৃষ্টির ভেতর মোবাইল ফোনটি পলিথিন দিয়ে ছাপিয়ে ধরে কল ব্যাক করে আজগর। ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে,
-হ্যালো আব্বা, আপনে কুনহানে?
-কী ওইছে ক। আমি খ্যাপ লইয়া যাইতাছি।
-মায় য্যান কেমুন করতাছে।
-কস কি! তুই তর ময়না খালারে ডাক দে। আমি আইতাছি।
বলেই ফোনটা কোনমতে কোমরে গুঁজে রিক্সায় টান দেয় আজগর। আজগরের চোখ লাল। চেহারায় গভীর আতঙ্কের ছাপ। বেশ জোরেই রিক্সা চালাচ্ছে সে। গারা-গর্তে পড়ে অনবরত ঝাঁকি খাচ্ছে রিক্সা। সাবিনা শক্ত করে ধরে রেখেছে খালিদকে। ভয় পাচ্ছে ও। খালিদ চিৎকার করছে- ‘এই ভাই, আস্তে যান। আস্তে যান।’ কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আজগরের। জোরে জোরে চালিয়েই যাচ্ছে। হঠাৎ গভীর গর্তে পড়ে উল্টে গেল রিক্সা। ‘উহ….হ!’ চিৎকার করে ওঠে সাবিনা। গর্তে পানি ভর্তি থাকায় খেয়াল করেনি আজগর কিংবা খেয়াল করার অবস্থায় নেই ও। আজগরের মনের ভেতর ঝড়, চোখে ভয়! রাজ্যের তাড়া আজ ওর। রিক্সাসমেত দুমড়ে মুচড়ে পড়ে গেছে ওরা। খালিদের চোখে মুখে আতঙ্ক! আজগরেরও! সাবিনা চুপ! কোনমতে উঠে দাঁড়ায় খালিদ। সাবিনাকে ধরে ফুটপাতে নিয়ে বসায়। কথা বলছে না সাবিনা। চোখ বন্ধ করে আছে। প্রচন্ড ঝাঁকিতে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। এ্যাবড়োথ্যাবড়ো রাস্তার উপর পড়ে পেটে খুব চোটও লেগেছে ওর। কাঁদা-পানিতে ভিজে গেছে শরীর। সাবিনার পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বসে খালিদ। আস্তে আস্তে ঝাঁকি দেয়।
–সাবিনা, সোনা। কথা বল। সাবিনা। সাবিনা।
সাবিনা স্তব্ধ। কথা বলে না। হঠাৎ খালিদের বুকের উপর নেতিয়ে পড়ে। একটু পর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
-‘ও তো নাই!’
-‘কি বলতেছ?’ বুঝতে পারে না খালিদ।
আস্তে আস্তে খালিদের হাত নিয়ে ওর উরুর কাছে ধরে সাবিনা। খালিদ তাকায় হাতের দিকে। ব্লিডিং হচ্ছে সাবিনার! মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে খালিদের। রাগে, দু:খে হাত পা কাঁপতে থাকে। সাবিনা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চিৎকার করে ওঠে খালিদ,
-ভাই রিক্সাটা উঠান। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলেন।
ততক্ষণে উঠে পড়েছে আজগর। সেও খুব ব্যথা পেয়েছে। খোড়াচ্ছে। কোনমতে রিক্সা ধরে উঠায় আজগর। চাকা বাঁকা হয়ে বসে গেছে। চলার মতন অবস্থায় নেই রিক্সা।
সাবিনাকে আস্তে আস্তে ফুটপাতে শুইয়ে দেয় খালিদ। সালোয়ার ভেদ করে রক্ত চুইয়ে পড়ছে ওর। উঠে দাঁড়ায় খালিদ। আশপাশে তাকিয়ে অন্য রিক্সা খোঁজে। পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে। ধারে কাছে কোন রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। এক কোণায় পড়ে থাকা ছাতাটার দিকে নজর পড়ে ওর। ছাতা ওঠায় খালিদ। ‘শুয়োরের বাচ্চা!’ বলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। ঝাঁপিয়ে পড়ে আজগরের ওপর। ছাতা দিয়ে উপর্যুপরি বাড়ি মারতে থাকে আজগরকে। আজগরের নাক ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। সিংহের মত গোঙাচ্ছে খালিদ। একটু পরে সাবিনার কাছে যায় ও। মাথাটি উঠিয়ে কোলের উপর নেয়। সাবিনাকে ধরে হাউমাউ করে শিশুর মতো কাঁদতে থাকে।
রক্তাক্ত নাক ধরে বসে আছে আজগর। নাক ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে তো বেরুচ্ছেই। থামছে না কোনমতেই। আবার ফোন আসে আজগরের। এক হাত দিয়ে ফোন উঠায় ও।
-‘হ্যালো, আজগইর‌্যা। তুই কুনহানে?’ কথা বলতে পারে না আজগর। ফোনের ওপাশ থেকে আবার
ভেসে আসে- ‘আমি ময়না কইতাছি। তর তো কপাল খুইলা গেছেরে, আজগইর‌্যা। তর পোলা ওইছে। তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়া বাড়িত আয়।’ কেটে যায় লাইন। আজগর চুপ। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বসে আছে ফুটপাতের ওপর।
এরই মধ্যে দু-একজন লোক জড়ো হয়ে গেছে। এদের মধ্যে কেউ একজন রিক্সা ডাকাডাকি করছে। বেশ ব্লিডিং হচ্ছে সাবিনার। আজগরেরও। ওদের দুজনের রক্ত ক্রমাগত মিশে যাচ্ছে রাস্তায় জমে থাকা পানির ভেতর।
——————

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন