মিন্টু শাহজাদা
বাংলাদেশ একটি উত্থানের নাম। বহু মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষা, রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ
আজ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি
ক্ষুদ্রায়তন এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার কিছু কিছু অংশে
মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তথাপি এই অংশের জনগণ একাত্তরের পূর্বে কোন পৃথক রাষ্ট্রের
জন্ম দেওয়ার সুযোগ পায়নি। তবে যুগ যুগ ধরে তারা কারো পরাধীনতাও স্বীকার করতে চায়নি।
বার বার ঔপনিবেশিক শক্তির যাতাকলে পরে এদেশের মানুষ হয়েছে নিপীড়িত, নির্যাতিত। পরাধীনতার
শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসার জন্য অনবরত বিদ্রোহের জন্ম হয়েছে, ফলস্বরূপ বহু মানুষকে সহ্য
করতে হয়েছে শোষক শ্রেণীর জুলুম, অত্যাচার। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবে
হতে হয়েছে নির্মম শোষনের স্বীকার। আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রভাবক
কিংবা নিয়ামক হিসেবে পরাধীন ভারতবর্ষ অথবা
পরাধীন বাংলায় শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংঘটিত নানাবিধ আন্দোলন, বিদ্রোহের অবদানকে অস্বীকার
করার কোন সুযোগ নেই। বস্তুত: ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আন্দোলনের ধারাবাহিকতা
হিসেবেই পাকিস্তান আমলে পরবর্তী সকল প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শক্তির
পতনের পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হল। কেবলমাত্র ধর্মের ধোঁয়া তুলে বাংলাকে সাথে
নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত ছিল। ভারত স্বাধীন হলেও বাংলা পরাধীনতার
শৃঙ্খল হতে বের হতে পারেনি। বাংলার জন্য এ যেন এক নব্য ঔপনিবেশিকতা। এক ধর্ম বাদ দিলে
বাংলার সংস্কৃতির সাথে পাকিস্তানের সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। মাঝখান থেকে
বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ পশ্চিম বাংলাকেও বাংলা থেকে কেটে পৃথক করা হয়েছিল। রাজনৈতিক
ও অর্থনৈতিক শোষনের পাশাপাশি পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষের সংস্কৃতির উপরও আঘাত হানতে
শুরু করে দিযেছিল, এমনকি বাংলা ভাষাকেও কেড়ে নেওয়ার মত জঘন্য ও ঘৃন্য অপচেষ্টা চালিয়েছিল।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির দু:সাহসিক ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান,
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন, সংগ্রাম, যুদ্ধই ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামেরই
অংশ। তবে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ, আন্দোলন হলেও
শোষক শ্রেণীর ক্রমাগত অত্যাচারের কারনে তা চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে
দিতে হয়েছে হাজারো বীর সেনানীকে। বাংলাকে মুক্ত, স্বাধীন করতে, বাংলার মানুষকে শোষক
শ্রেণীর হাত থেকে রক্ষা করার আন্দোলনকে বাস্তবে রূপদান করতে, অবশেষে এক অবসংবাদিত মহান
নেতার আবির্ভাব হয়েছিল, যার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত,
হাজারো মা বোনের সম্ভ্রম, বঙ্গবন্ধুর পর্বতকঠিন ব্যক্তিত্ব, দেশ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম
ভালবাসা আর দু:সাহসী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারনেই আজ স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত
হতে পেরেছে।
বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত আজকের বাংলাদেশ দ্রুত
গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে, গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ঈর্ষনীয় উন্নয়ন
সাধিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে উদীয়মান শক্তি হিসেবে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে বাংলাদেশের
অবস্থান। কৃষি, শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স,
বিনিয়োগ, অবকাঠামোর উন্নয়নসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে প্রভুত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। বেকারত্বেও
হার কমেছে, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে,
জীবন মানের উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তাঘাট, সেতু, উড়ালসড়ক, গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ, স্যাটেলাইট
টেলিভিশন এমনকি ইন্টারনেট দেখে মনে হয় বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় উন্নতিশীল দেশের সারিতে
গিয়ে দাঁড়াতে আর বেশি দেরি নেই। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ
হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারনে তা সম্ভব হযেছে। তাঁর ঘোষিত ’রূপকল্প-২০২১’ অনুযায়ী
বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হল, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলদেশ ইতোমধ্যেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে
পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের এগিয়ে চলা এখন দৃশ্যমান ও বিশ্বব্যপী স্বীকৃত। বিশেষ করে সামজিক
সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক দেশের জন্য এখন উদাহরণ। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতটা
শক্তিশালী হবে তা নিয়ে গবেষণা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস
ওয়াটারহাউস কুপারস (পিডব্লিউসি)। তাদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির
দেশ হবে বাংলাদেশ (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৪, ২০১৫)।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর কলঙ্ক ও ন্যাক্কারজনক
ঘটনা না ঘটলে, বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে, বাংলাদেশ হয়ত বহু আগেই উন্নতিশীল দেশের কাতারে
গিয়ে দাঁড়াতে পারত। জননেত্রী শেখ হাসিনার উত্থান হওয়ার আগে এবং ৭৫ পরবর্তী শাসকগণ বঙ্গবন্ধুর
নীতিকে কতটা কাজে লাগাতে পেরেছিলেন তা ভাবনার বিষয়। যদি বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে দেশ
পরিচালিত হত, তাহলে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতি ছড়িয়ে পড়ত না। বাংলাদেশ হয়ত সোনার
বাংলায় পরিণত হতে পারত। বঙ্গবন্ধু বাংলা ও বাংলার মানুষের মুক্তির কথা বলেছিলেন। এ
মুক্তি কেবল রাজনৈতিক মুক্তি নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি বাংলার
মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন অর্থনৈতিক
মুক্তির কথাই বার বার জানান দেয়। বিশেষত ৬ দফার তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় জনগণের
অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই মূর্ত হয়ে ওঠে। তৃতীয় দফা ছিল মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা সম্পর্কিত।
এতে বলা হযেছিল, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে
হবে, যা পারস্পরিকভাবে কিংবা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময়যোগ্য। এ ক্ষেত্রে দু’অঞ্চলে স্বতন্ত্র
বা পৃথক পৃথক স্টেট ব্যাংক থাকবে এবং মুদ্রার পরিচালনা ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের
হাতে। অথবা, এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি মুদ্রা ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে এই শর্তে
যে, একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অধীনে দুই অঞ্চলে দুটি
রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তাতে এমন বিধান থাকতে হবে যেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ
হস্তান্তর কিংবা মূলধন পাচার হতে না পারে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে
মুলধন পাচার বন্ধ করার জন্য সংবিধানে কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে। পঞ্চম দফা ছিল বৈদেশিক
বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা সম্পর্কিত। এতে পাঁচটি বিধান সুপারিশ করা হয়। (ক) ফেডারেশনভুক্ত
(প্রথম দফায় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের ভোটাধিকারের মাধ্যমে
ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় রাষ্ট্রকাঠামোর সুপারিশ করা হয়েছিল।) প্রত্যেকটি
অঙ্গরাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে। (খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে
অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলোর এখতিয়ারে থাকবে এবং অঙ্গরাজ্যের প্রয়োজনে অঙ্গরাজ্য
কর্তৃক ব্যবহৃত হবে। (গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে
অথবা সর্বসম্মতনির্দিষ্ট হারে অঙ্গরাজ্যগুলো মিটাবে। (ঘ) অঙ্গরাজ্যের মধ্যে দেশজ দ্রব্য
চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন বাধা থাকবে না। (ঙ) সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে
বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্য প্রতিনিধি দল প্রেরণের এবং স্ব স্ব স্বার্থে বাণিজ্য চুক্তি
সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
এ কথা স্পষ্ট যে, ৬ দফা দাবি ছিল মুলত বাংলার
মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ; বঙ্গবন্ধুর দু:সাহসী অগ্রযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এখানে বাংলার মানুষের পক্ষে অর্থনৈতিক প্রপঞ্চগুলোকে অধিক হারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রণয়ন করা হয়েছিল। ৬ দফা ঘোষনার সাথে সাথে
এটিকে রাষ্ট্রের শত্রুতা এবং বিচ্ছিন্নবাদী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি আইয়ুব
সরকারের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সে সময়ে আওয়ামীলীগের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকাও ৬ দফা ঘোষনার পরেও অনেকদিন
৬ দফাকে সমর্থন দেয়নি। বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুগত ছাত্রলীগ কর্মী ও সহযোগীদের দ্বারা প্রথমে
গোপনে এবং পরবর্তীতে প্রকাশ্যে ৬ দফা দাবী জনগণের সামনে তুলে ধরেন এবং ব্যপক জনসমর্থন
পান।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। যুদ্ধপীড়িত দেশ। চারদিকে কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। গ্রামের পর গ্রাম
জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাড়িঘর, কলকারখানা, দালান মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হযেছিল। লাখ
লাখ কৃষকের কাছে জমিতে হাল বাওয়ার জন্য কোন গরু ছিল না। রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট
সব ভেঙে পড়েছিল। অভ্যন্তরীন নৌ যোগাযোগেও ছিল নানা বিঘ্ন। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি
ভেঙে পড়েছিল। ব্যবসা বাণিজ্যের সকল অর্থ ও উপকরন এমনকি কলকারখানার যন্ত্রপাতিও পশ্চিম
পাকিস্তানে পাচার করে দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক হিসাবে মাত্র ১১৭ রুপি জমা ছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও কয়েনগুলো জ্বালিয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ নগদ টাকার
সংকটে পড়ে। রাস্তা থেকে সকল প্রাইভেটকার এমনকি ডিলারদের কাছ থেকে গাড়ি নিয়েও দেশ স্বাধীনের
আগ মূহুর্তে তা পাচার করে দেওয়া হয়। দেশটা যেন ভূতুড়ে এক নগরী। এমনই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু
দেশের হাল ধরলেন। বিভিন্ন দিক থেকে হতাশার বাণী শোনানো হচ্ছিল। অনেকে উপহাস করছিলেন
এই বলে যে, এদেশ স্বাধীন হলেও অস্তিত্বেও সংকটে পড়বে। টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু
অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু তাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করলেন। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী
পরিকল্পনা ও নীতির কারনে অল্প কিছুকালের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ালো বাংলাদেশ। দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির
পাশাপাশি তাঁর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছিল অনেক বেশী সুক্ষ ও সুদূরপ্রসারী। দেশের দরিদ্র
কৃষক শ্রেণী, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি।
দেশের ভার গ্রহণ করার সাথে সাথেই বঙ্গবন্ধু
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বপ্রথম দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে সচল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন।
রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্টসহ ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবকাঠামোর পুন:নির্মানের ব্যবস্থা করলেন।
বন্দরে বন্দরে মাইন পোতা ছিল, মাইন অবমুক্ত করে সেগুলিকে সচল করলেন। মিত্র দেশগুলি
থেকে সাহায্য সহযোগিতা এনে দেশের মানুষের জন্য ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করলেন। শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, সংবিধান প্রণয়নসহ একটি রাষ্ট্রকাঠামোর জন্য যা যা প্রয়োজন হয়, অত্যন্ত
বিচক্ষনতার সাথে তা প্রণয়ন করার ব্যবস্থা নিলেন। কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল না। দেশের
অর্থনীতির সূতিকাগার হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেন। পাকিস্তান আমলে সকল
ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধু কয়েকটি করে ব্যাংক একিভূত
করে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেন। এখনকার সোনালী, রূপালী প্রভৃতি ব্যাংক
বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বাংলাদেশ যাতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন
করতে পারে সেজন্য দেশের কৃষিখাতকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখেছিলেন তিনি। কৃষি উন্নয়নকে
ত্বরান্বিত করার জন্য কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেন। এদেশের সাধারণ কৃষকদের বিরুদ্ধে
পাকিস্তানি আমলে দায়ের করা হাজার হাজার সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের অব্যাহতি দিয়ে
সমস্ত বকেযা ঋণ সুদসহ মাফ করে দেওয়া হয়। কৃষিকে আধুনিকায়ন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো
পুন:র্নিমানের জন্য হাজার হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত
জমির খাজনা রহিত করা হয়। দরিদ্র কৃষকদের রেশন সুবিধা, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কমমূল্যে
কৃষিবীজ সরবরাহ, কৃষিপন্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে কৃষি উৎপাদনকে উৎসাহিত ও ত্বরান্বিত
করা হয়।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, এখনই যদি দেশের
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার লাগাম টেনে না ধরা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যা
দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই একটি পরিকল্পিত জনসংখ্যানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অংশ
হিসেবে তিনি বেশ কয়েকটি থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা
করেন। ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। এ কারনে প্রাথমিক শিক্ষাকে
অবৈতনিক এবং প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে জাতীয়করণ করা হয়। দেশের আয় ও উৎপাদনে গতি আনার জন্য
বঙ্গবন্ধু পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এতে জাতীয় আয়, প্রবৃদ্ধি ও তার সুষম বন্টনের
প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়। সম্পদের সুষম বন্টনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সকল শিল্প-কারখানা
জাতীয়করণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই তাঁর সকল
পরিকল্পনাই ছিল বিশেষত দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই। কখনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয়
দেননি তিনি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী হাতে নিয়ে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী
করতে চেয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে দেশ থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র দূর করাই ছিল
বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য। বার বার তিনি ছুটে গিয়েছেন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। উদ্দেশ্য একটাই, বৈদেশিক
বাণিজ্য স্থাপন, কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও দেশের মানুষের রুটি রুজি যোগাড়ের ভিত নির্মান।
দেশকে গড়ার জন্য খুবই কম সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তবুও আজকের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির মূল স্তম্ভ বঙ্গবন্ধুর হাতেই নির্মিত। আফসোস! তিনি
আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারলে হয়ত এই স্তম্ভের উপরই নির্মিত হতে পারত অর্থনীতির বড়
বড় ইমারত। বাস্তবায়িত হতে পারত লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন। বহু আগেই দেশ
পরিণত হতে পারত সোনার বাংলায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন