সূচীপত্র

শনিবার, ডিসেম্বর ১০, ২০১৬

একজন হাচেন বেপারি ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প


মিন্টু শাহজাদা

মোল্লা বাড়িতে মানুষ নেই। কদু গাছের ডগাগুলো জংলা হতে ঝুলে পড়ে আছে অনেকদিন। উঠিয়ে জংলার চটায় আটকে দেবার লোকও নেই। বাড়িতে ঘরগুলোতে তালা ঝোলানো ছিল। মিলিটারিরা আগুন দেবার পর ঘরগুলো আধাপোড়া অবস্থায় পড়ে আছে। কয়েকটা তালা আবার নির্বোধের মতোন ঝুলে আছে পোড়া দরজায়। আগুন ঠিকমত লাগাতেও পারেনি পাকি বলদগুলো। কবুতরের খোপগুলোও ভেঙ্গে পড়ে আছে। ভয় পেয়ে নয়ত খাবার না পেয়ে উড়ে গেছে কবুতরগুলো। বাড়ির উঠানে আধমরা কুকুরটা শুয়ে আছে নিরবে। এ বাড়িতে মানুষ নেই অনেকদিন। বাড়ির ছোট ছেলে খলিল মোল্লা পাড়ায় পাড়ায় হা-ডু-ডু খেলে। মাঝে মাঝে হায়ারেও যায় এ গ্রামে ও গ্রামে। নাটক, যাত্রাগানও করে। আমোদ আহ্লাদে গ্রামের মানুষকে মাতিয়ে রাখে। এ গ্রামে মিলিটারিরা ঢোকার আগে খলিলের শহরের বন্ধুরা এসেছিল বাড়িতে। তারপর থেকে খলিল আর তার দলবল কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। শোনা যায়, ওরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। বাড়ির মেয়ে বউঝিসহ সবাই আগেই ছাইবেড়ে চলে গেছে। ছাইবেড়ে অনেক দূর। ওখানে মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে, নৌকা করে, ক্ষেতের আইল বেয়ে, বহুদূর হেঁটে হেঁটে যেতে হয়। যেতে তাও দিন তিনেক তো লাগেই। পাক বাহিনী ওখানে এখনও যায় নাই। হয়ত যেতে পারে নাই। যাবেই বা কেমন করে। অত দূর্গম জায়গায় তো গাড়ি ঘোড়া চলে না। ভাগ্যিস মোল্লা বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল ওদেশে। নইলে সবাই যেত কোথায়? অন্যদের মতো গুলি খেয়ে মরে মরে বাড়ির উঠোনে পড়ে থাকতে হত।


আদমপুর গ্রামে মানুষ নেই বললেই চলে। ওসমান আর ওর মা পচে গেছে বাঙ্কারের মধ্যে। পচবেই বা না কেন! পাক মিলিটারিরা কতবার করে বলল, ʻইধারমে আও, ইধারমে আও।’ ʻপাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে ওসমান এগিয়েই তো যেতে চেয়েছিল। ওর মা-ই তো ছাড়ল না। বুকে চেপে ধরে রেখেছিল শক্ত করে। । 
ʻবাজান যাইস ন্যা। ওরা তোরে মাইর‌্যা ফেলাবেনে। যাইসন্যা বাজান।’
বুড়ি এত শক্তি পেল কোথায় কে জানে। ঠিকমত তো হাঁটতেই পারত না। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটত। অথচ ওসমান মায়ের বুক থেকে ছোটার বহু চেষ্টা করেছে। অত বড় জোয়ান মর্দ ছেলে মায়ের শক্তির সাথে পারে নাই। মিলিটারিরা গুলি করে বাঙ্কারের মধ্যেই দুইজনকে শুইয়ে দিয়েছে। গুলি খাওয়ার পরে চাগাড় দিয়ে উঠতে চেয়েছিল ওসমান । পারে নাই, কিছুক্ষণ পরেই মা-পুতে জড়াজড়ি করতে করতে স্থির হয়ে গেছে ।

সারা গ্রামে পচা, আধাপচা লাশের ছড়াছড়ি। হাচেন বেপারি গত তিন দিন ধরে লাশগুলা মাটি দেওয়ার কাজে ব্যস্ত। একা আর কত পারা যায়! পাকি বেটারাও আছে- একসাথে এত মানুষ মারলে ওগুলো মাটি দেওয়া যায়? মাটি না দিলেও তো সমস্যা। গ্রামটা মরা মানুষের ভাগাড় হয়ে যাবে, সারা গ্রামে পচা লাশের গন্ধ ছড়াবে। সারাদিন ধরে মাটি দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকলেও তো হত। দিনে দুই তিনবার ছুটতে হয় আবার গোলাপপুর বাজারে, আর্মিদের ক্যাম্পে। শালারাও আছে, সকাল নাই, বিকাল নাই, রাত নাই, নিশি নাই, এটা নিয়ে আস, ওটা নিয়ে আস। কাহাতক সহ্য হয়! মুন্সি বাড়ির আমেদ মুন্সিকে কতবার বোঝালো আয়, রাজাকারে নাম দে, কেউ তোকে মারবে না। রাজার হালে থাকবি। দিন শেষে টাকা পাবি। মাঝে মাঝে ভাল মন্দ খাবারও পাবি। সপ্তায় সপ্তায় ক্যাম্পে কত কি রান্না হয়! আর্মিরা সব খেয়ে শেষ করতে পারে না। মাঝে মাঝে হাচেনকেও ডাকে খেয়ে যাবার জন্য। ক্যাম্পের বারান্দায় বসে হাচেন প্রানটা ভরে খায়। এত সুন্দর সুন্দর খাবার জীবনেও খায়নি। বিনিময়ে কাজ তো খুব বেশি নয়। খালি মুক্তি বাহিনীর আখড়ার খোঁজ খবর দেওয়া, কোন বাড়িতে সুন্দরী আওরত আছে তার খবর দেওয়া, বাজার ঘাট করা, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মুরগী, গরু ছাগল ধরে এনে জবাই করে মাংস বানিয়ে ক্যাম্পে চালান করা, এইতো। আমেদ মুন্সিকও দোষ দেয় কি করে, চোখের সামনে জোয়ান নতুন বউটাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেলে কি মাথা ঠিক থাকে? আহারে বেচারা আমেদ! সুন্দরী বউটা হারিয়ে চোখের জলে বুক বুক ভাসিয়ে শেষমেশ মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিলি। আমেদ থাকলে হাচেনের কষ্ট কত কমে যেত!  

গ্রামে গ্রামে লাশ মাটি দেওয়ার কাজটা হাচেনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। হাচেন নিজের উদ্যোগেই লাশগুলি মাটিতে পুতে রাখে। হাজার হলেও গ্রামের মানুষই তো। লাশ মাটি দেওয়ার সময় কোন নিয়ম কানুনও মানতে পারে না। পাঁচ সাতজনকে একই গর্তে পুতে দেয়। তবে একই বাড়ির কর্তা, বউ-ঝি, পোলাপানের লাশকে একই গর্তে রাখতে চেষ্টা করে। মুত্যুর পরেও এরা একসাথে থাকুক হাচেন তা চায়। অবশ্য সব সময় পারেও না। ছোট পরিবার হলে আশপাশের প্রতিবেশী লাশের মধ্য থেকেও দু-একজনকে নিয়ে আসে তাদের গর্তে। বার বার গর্ত করাও ঝামেলা, অনেক সময়ের দরকার। মাঝে মাঝে হিন্দু আর মুসলমানদেরকেও একই গর্তে পুতে দেয়। হাচেনের ভয় হয়। হিন্দু-মুসলিম একই গর্তে মাটি দিলে আবার পাপ হবে না তো! কিন্তু কি আর করা, উপায় নাই। এত এত লাশ! সবগুলোতেই পচন ধরতে শুরু করেছে। কিছু কিছু আবার গলেও গেছে। ওগুলোকে যত তাড়াতাড়ি মাটি দেওয়া যায়, ততই ভাল। শালার লাশগুলোও আছে, মরার পর এদের ওজন এত বেড়ে যায় যে, টেনে সরানোই মুশকিল। অনেক চিন্তা হলেও হিন্দু মুসলিম লাশগুলো একসাথে মাটি দেওয়ার সময় তার কিছুটা আনন্দও যে হয় না তাও ঠিক নয়। হাচেন নিজেও তো অর্ধেক মুসলিম, অর্ধেক হিন্দু।

লাশ মাটি দেওয়ার সময় হাচেনের খুব বেশি কান্না আসেনা। মাঝে মাঝে আসে। গত পরশুদিন সরকার বাড়ির উঠানে এক মহিলার লাশ পড়েছিল। লাশের পাশে মহিলার দুধ মুখে দেওয়া তার বাচ্চাটিও মরে পড়েছিল। বাচ্চাটার গায়ে গুলি লাগে নাই। দুধ খেতে না পেয়ে মরে গেছে হয়ত। মরা মায়েদের স্তনে তো আবার দুধ থাকেনা। মরার পরে আবার দুধই কি, বাচ্চাই কি! হাচেন কোনদিন মায়ের দুধ খেযেছে কিনা জানেনা। মায়ের দুধ কেমন হয় জানে না। জানবে কেমন করে? মা তো সেই জন্মের পরই মরেছে। হাচেনের কথা একবারও ভাবেনি। মায়ের ওপর মাঝে মাঝে এজন্য হাচেনের খুব রাগ হয়। মরে শক্ত হয়ে যাওয়া বাচ্চার মুখ মায়ের দুধ থেকে ছোটাতে গিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠেছিল ও। মায়ের কথা মনে হযেছিল খুব। ফুপিয়ে ফুপিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছে হাচেন। শেষে মা ও বাচ্চাকে এক গর্তে রেখে মাটি দিয়ে দিয়েছে।

চোখের সামনে মানুষগুলিকে পাখির ঝাঁকের মত গুলি করে করে মেরেছে শুয়োরেরা। মাঝে মাঝে এতে হাচেনের খুব রাগ হয়েছে। ইচ্ছা করেছে রাইফেল কেড়ে নিয়ে পাকি কুত্তাদেরকে গুলি করে সাফ করে দেয়। বাঞ্চদেরা বহু জ্বালাচ্ছে! কিন্তু সাহসে কুলায় নাই। রাজাকারে নাম লেখিয়ে তাও তো জানটা বাঁচাতে পেরেছে, দু-বেলা খেতে পারছে। হাচেনের তো আবার তালুকদার বাড়ি ছাড়া যাওয়ার জায়গাও নেই। মাঝে মাঝে পাকিদের হাতে একটু আধটু গালি কিংবা চড় থাপ্পর খেতে হয়, এই যা। গালিগালাজ, চড় থাপ্পর তো তার তালুকদার কাকাও মারে। ছোট বেলা থেকেই তো হাচেনদের বাপ-দাদারা এই তালুকদারদের চড়-থাপ্পর খেতে খেতে মানুষ। হাচেনের দাদা খেয়েছে, বাপ খেয়েছে, এখন হাচেন খায়। ওর দাদার বাপ কিংবা তার বাপ খেয়েছে কিনা সে তা জানে না।  পাকিদের সব গালি সহ্য হলেও ʻনাযায়েয আওলাদ’ গালিটা সহ্য হয় না। হাচেনের তখন ইচ্ছা করে শুয়োরের বাচ্চাদের টুটি কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে কিন্তু সাহসে কুলায় না। মনের জিদ তার মনের মধ্যেই শুকিয়ে যায়। ʻজারজ’, ʻজারজের বাচ্চা’, ʻছ্যাদারের বাচ্চা’, ʻনাপাক শুয়োর’, ʻমালাউনের বিচি’  গালিগুলো তো জীবনে কম শুনে নাই। উঠতে বসতে গ্রামের লোকেরাও কতবার বলেছে। তখনও ইচ্ছা করছে জবাব দিতে। কখনও দিয়েছে, কখনও সাহসে কুলায় নাই।

হাচেনের কি দোষ! ওর হিন্দু মাকে ওর মুসলিম বাপেই তো বিয়ে করে ঘরে তুলেছে। সরকার বাড়ির ছেলেরা খেলার মাঠে হাচেনকে খেলায় নিত না। বলত, তুই তোর বাপের পোলা না। তুই তালুকদারের জারজ পোলা। তুই শালা জারজ। তুই ভাগ শালা মালাউন জারজের বাচ্চা। এ কথা নিয়ে কত মারামারি হয়েছে ওর সরকার বাড়ির ছেলেদের সাথে। কোনদিনও মারামারিতে জিততে পারেনি হাচেন। কেবল মার খেয়েছে। একবার তো মারের চোটে দুদিন জ্ঞানই ফেরেনি। বাপের উপর ওর খুব রাগ হত। বহুবার পাড়ার ছেলেদের এরকম অপমানের নালিশ বাপের কাছে করেছে। শালার বাপ এসব শুনেও চুপচাপ থাকত। কিছু বলত না। মায়ের কাছে বলবে কি করে। মা তো হাচেন মাসুম থাকতেই গলায় দড়ি দিয়েছে। মাঝে মাঝে ওর সন্দেহও হত। তালুকাদেরর চোখের দিকে তাকালে কেমন যেন চুপসে যায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তালুকদারকে জিজ্ঞেস করতে। সাহসে কুলায় না। অতবড় ক্ষমতাধর, মুসলিম লীগের অত বড় নেতা, পাকিদের কত বড় প্রিয়ভাজন, যার আঙুলের ইশারায় বাঘে, মহিষে এক ঘাটে জল খায়, তাকে একথা জিজ্ঞেস করা যায়?

হাচেন তালুকদার বাড়ির ফুট ফরমায়েশ খাটে ছোটবেলা থেকেই। ওর বাপ যেবার ধান ক্ষেতে গলা কাটা অবস্থায় পড়েছিল, তার পর থেকে। হাচেনের বাবাকে কারা মেরেছিল, কেন মেরেছিল ও কোনদিনও জানতে চায়নি। জানবার ইচ্ছেও জাগেনি কোনদিন। তবে লোকমুখে শুনেছিল, তালুকদারের সাথে ওর বাপের কি নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছিল মরার আগের দিন। খুব নাকি চেচামেচি করেছিল ওর বাপ। এসব কথা হাচেন কোনদিন জানতে চায়নি, জানতে ইচ্ছে করেনি। লোকেরা বলাবলি করত, হিন্দুপাড়ায় হাচেনের মামাবাড়িতে তালুকদার সাবের বেশ যাতায়াত ছিল। তালুকদার মুসলিমলীগের বড় নেতা। হিন্দু পাড়ায় যেতেই পারে। এ নিয়ে এত জলঘোলা করার কি আছে? তবুও লোকে বলে, হাচেনের নানা নাকি একবার তালুকদার বাড়িতে এসে খুব কান্নাকাটি করেছিল। তার কয়েকদিন পর,  কি এক অজানা কারণে তালুকদার বাড়ির কাজের লোক, হাচেনের বাপের সাথে ওর হিন্দু মায়ের বিয়ে হয়েছিল। ওর মা নাকি মুসলিমও হয়েছিল। তবে শোনা যায়, মুসলিম হওযার পরেও হাচেনের মা লুকিয়ে লুকিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পড়ত। বিয়ের কিছুদিন পর পরই হাচেনের নানারা জ্ঞাতি গোষ্ঠিসহ ভারতে চলে গেছে। আর কোনদিন ফেরেনি। ওরা কোথায় গেছে, কেন গেছে, হাচেন জানতে চায়নি কোনদিন। জানতে ইচ্ছে করেনি। বিয়ের পাঁচমাস পরেই নাকি ওর জন্ম হয়েছিল।

তালুকদার বাড়িতে হাচেনের খুব বেশি কাজ নেই। বাড়ির ছেলে-বউসহ সবাই বিলেতে চলে গেছে। তালুকদার সাবের বড় ছেলে বিলেতের মস্ত বড় ডাক্তার। যুদ্ধ লাগবে এ কথা হয়ত তিনি আগেই জানতেন। জানবেনই বা না কেন? তালুকদার সাব মুসলিম লীগের এত বড় নেতা, পাকিদের এত প্রিয়ভাজন!  তাই ছেলে বুড়ো সবাইকে আগেই বিলেতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শুধু তালুকদার মশাই রয়ে গেছেন। দেশে থাকলেও তিনি বাড়িতে থাকেন না। আর্মিদের ক্যাম্পেই থাকেন। বাড়িতে থাকলেই বা কি? তাঁর আবার ভয় কি? এত এত পাক বাহিনী থাকতে নিরাপত্তার কোন অভাব আছে? তালুকদার মশাই ক্যাম্পের ভেতর খান-দান, মিলিটারিদের সাথে ফূর্তি-ফার্তি করেন। এ বয়সেও বুড়োর যা তেজ! তাই হাচেনের আর কাজ কি? নিজের জন্যই দুবেলা রান্না-বান্না করা। শুধু মিলিটারিরা আসলেই ওর কাজ। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে মুরগী, গরু-ছাগল ধরে এনে জবাই করা, ওগুলোকে ছিলে মাংস বানিয়ে দেওয়া, মুক্তিবাহিনীর খোঁজ খবর দেওয়া, এই আর কি। মোল্লা বাড়ির খলিলেরা মুক্তিবাহিনী। মিলিটারিরা গ্রামে ঢুকলে মাঝে মাঝেই এরা হানা দেয়। হঠাৎ হঠাৎ কোত্থেকে এসে বৃষ্টির মত গুলি ছোঁড়ে। পাকবাহিনীর সাথে কুলোতে পারে না। হঠাৎ আবার কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। সব পাকিরা না মরলেও দু-চারজন তো মরেই। আর্মিদের গুলিতে দু-একজন মুক্তি বাহিনীও মরে। মুক্তি বাহিনীদের মধ্যে যারা মরে, তাদেরকে হাচেন চেনে না। খুব সুন্দর সুন্দর ছেলেগুলা। দেখে মনে হয় অনেক বড় ঘরের সন্তান। হাচেন শুনেছে এরা ঢাকা শহরের ভার্সিটি না কি বলে সেখান থেকে এসেছে। এই ছেলেগুলো কি কারণে যে এখানে মরতে এসেছে এটা হাচেনের মাথায় ধরে না। পাক বাহিনী গ্রামে ঢুকলে মুক্তিবাহিনী টের পায় কি করে, এটা নিয়ে তাদের নানান প্রশ্ন। হাচেনকেও সন্দেহ করেছে কয়েকবার। কয়েকবার বন্দুকও ঠেকিয়েছে ওর বুকে। কোথায় আছে মুক্তি বাহিনী তা খুঁজে বের করার জন্য হাচেনকে তালুকদার মশাইয়ের কড়া নির্দেশ। আর্মিরাও এসে বার বার তাগাদা দেয়। খোঁজ দিতে পারে না বলে গালিগালাজও করে, বন্দুক ঠেকায় বুকে। হাচেনের বুকটা ভয়ে দুপদুপ করে ওঠে। আর্মিরা গুলি করে না। কেবল ভয় দেখায়। তালুকদারের লোক বলেই হয়ত গুলি করে না।

বাড়িতে কদিন কাজ নেই বলে লাশগুলো মাটি দিতে সমস্যা হচ্ছে না হাচেনের। মুক্তিবাহিনীর খোঁজ নেওয়াটাও জরুরী। খোঁজ না দিতে পারলে সত্যি সত্যিই যদি আর্মিরা এসে গুলি মেরে দেয়- এই চিন্তাও হয় ওর কিন্তু লাশগুলো মাটি না দিয়ে যায় কি করে। পচে পচে লাশগুলো থেকে তো গন্ধও ছুটতে শুরু করেছে। হাজার হলেও এরা এ গ্রামেরই তো মানুষ। মরে পচে গেছে এই যা। লাশগুলোর জন্য বড্ড মায়া হয় হাচেনের। শুধু মায়া হয় না সরকার বাড়ির ছেলেগুলির উপর। টেনে হিঁচড়ে একটার পর একটা লাশ ফেলে মাটিচাপা দেয়। ইচ্ছে করে এ মড়াগুলোকে পায়ে পিশে ফেলে। যা জ্বালান জ্বালিয়েছে জীবনভর! মরা লাশকে লাথি মারলে যদি পাপ হয়, এই ভয়ে লাথি মারে না হাচেন। তাছাড়া মড়ার ওপর আবার শোধ কি? মড়া তো মড়াই! 

গ্রামে তো আর মানুষ নেই। তাই সুন্দরী আওরতের খবর দেবারও নেই। যা ছিল, সবই ক্যাম্পে আছে এখন। অন্য মেয়েদের সাথে আমেদের বউ জরিকেও মাঝে মাঝে ক্যাম্পে দেখা যায়। ভাল মন্দ খেয়ে মোটা হয়েছে খুব। দিনে দিনে খুব সুন্দর হয়েছে। শুধু চোখের নিচেই একটু যা কালি। ঠিকমত ঘুমায় না হয়ত। হয়ত ঘুম আসে না। ক্যাম্পে কখনও দেখা হলে জরি চুপচাপ চেয়ে থাকে হাচেনের দিকে। কিছু হয়ত বলতে চায়। হয়ত আমেদের খবর জানতে চায়। হাচেনের ইচ্ছা, যুদ্ধ শেষ হলে আমেদ মুন্সি যদি জরিকে না নিতে চায়, তাহলে জরিকে বিয়ে করবে সে। বিয়ে করে দেশান্তরি হবে। আদমপুর গ্রামে আর থাকবে না। তালুকদার বাড়ির চড়-থাপ্পর থেকে অনেক দূরে গিয়ে ঘর বাঁধবে। জরির সাথে ঘর বাঁধবেই বা না কেন? বয়স তো আর কম হলোনা। কেউ তো মেয়েও দিল না,  কোনদিন দেবেও না- হাচেন এটা এতদিনে বুঝে গেছে।

গরু জবাই করা বড় ছুরিটাতে পাথরের ওপর ঘসে ঘসে ভাল করে ধার দিচ্ছে হাচেন। ক্যাম্পের ভেতরই বড় একটা গরু জবাই করতে হবে। আজ তাই সে ক্যাম্পে। কি না কি উৎসব আছে পাকিদের। খানাপিনা হবে, মদ আর আওরত নিয়ে ফুর্তি করবে সব। রান্না হলে কত কি খেতে পারবে সে! অথচ কি এক অজানা আবেগে চোখ, মুখ লাল হাচেনের। অনবরত ঘামছে। কেবল ঘামছে। হঠাৎ বোমার শব্দ! চারদিকে দিগ্বিদিক ছুটছে আর্মিরা। বৃষ্টির মত গুলির শব্দ। হাচেন ছুরি হাতে দৌড়ে গেল তালুকদার সাবের ঘরের দিকে। ওখানে খলিল আর আমেদও ঢুকে পড়েছে। ওদের হাতে মেশিনগান। হাচেনের হাতে ধারালো ছুরি। দরজা ভেঙেই ঢুকে গেল ওরা। জনাব আমীরউদ্দিন তালুকদার। মুসলীমলীগের দাপুটে নেতা। পাকিস্তানিদের প্রিয় ভাজন। যার আঙুলের ইশারায় বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খায়। লাফ দিয়ে গিয়ে টুটি চেপে ধরে খলিল। লাথি দিয়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। পারা দিয়ে ধরে বুকের উপর। মেশিনগান ঠেকিয়ে ট্রিগার চাপার আগেই এক ঝটকায় টান দিয়ে সরিয়ে দেয় হাচেন। বাঘের মত হুঙ্কার দিয়ে ওঠে সে।
ʻসইর‌্যা যা খলিল। শুয়োরের বাচ্চারে আমার কাছে ছাইড়্যা দে।’
বলেই সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মেরে পারা দিয়ে ধরে হাচেন।  তালুকদার সাব কঁকিয়ে ওঠে। আতঙ্কে চোখ লাল  হয়ে ওঠে ধামড়া বুড়োর। চিৎকার করে ওঠে।
ʻহাচেন তুই!’
ʻহ আমি। আমি হাচেন।’
ʻআমারে মারিসনা হাচেন। আমি তোর বাপ। তোর শরীরে আমার রক্ত। তুই আমার ঔরসের সন্তান। আমারে মারিসনা বাপ।’
ʻশুয়োরের বাচ্চা, এতদিন কই ছিল তোর বাপগিরি? তোর মত বাপের গুষ্টি মারি। তুই একটা ইবলিশ।’ গর্জে ওঠে হাচেন।

তালুকদারের গলায় ধারালো ছুরি বসিয়ে দিয়েছে হাচেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। ঘোৎ ঘোৎ করে আওয়াজ হচ্ছে। চারিদিকে গোলাগলির মুহুর্মুহু শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে সে আওয়াজ। তালুকদারের ধর থেকে মাথা আলাদা হওয়ার আগ পর্যন্ত হাচেন ছুরি চালিয়েই যাচ্ছে।
                                    --------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন