সূচীপত্র

সোমবার, ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০১৭

প্রচার মাধ্যমে বিকৃত বাংলাভাষা ও আমার কিছু সুপারিশ

মিন্টু শাহজাদা

আমাদের কয়েকজন বন্ধু আর. জে. মানে রেডিও জকি হয়েছিল। কারা যেন এর বাংলা নাম দিয়েছে ‘কথাবন্ধু।’ এই আরজে’র বাংলা রূপ কথাবন্ধু যে কার মাথা থেকে এসেছে জানিনা। কথাবন্ধু না হয়ে অন্য কিছু হলে হয়ত ভাল হত। ’কথা বলে যে বন্ধু’ কিংবা ’কথার বন্ধু’ যে সমাসেই ফেলেন না কেন তা কিন্তু রেডিও কিংবা বেতারকে প্রাসঙ্গিক করে না। আর কথা তো সবাই বলে। সবাই কি কথাবন্ধু? পাগলও তো কথা বলে। ফেরিওয়ালা মধুর স্বরে হাক দেয় – ‘এই মুরগী…..!’ সবাই কথা বলে। তাহলে কথাবন্ধু কি করে আরজে’র বাংলা রূপ হতে পারে?
তাই ’আরজে’ পারিভাষিক বাংলা শব্দ হিসেবেই প্রচলিত হতে পারে অথবা বেতারকে প্রাসঙ্গিক করে এবং আরজে কে প্রাসঙ্গিক করে এমন কোন বাংলা শব্দ বিবেচিত হতে পারে। যাই হোক প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যারা আরজে হয়েছিল (এখনও আছে কিনা জানি না।) এদের মধ্যে অনেকে সুন্দর এবং বিশুদ্ধ বাংলা বলতে পারত। অনেকে ভাল আবৃত্তিও করতে পারত।বাংলা উচ্চারণে কোন ইংরেজির প্রভাব ছিল না। কথার ফাঁকে ফাঁকে অযথা So, But, Anyway, Awesome প্রভৃতির অপ্রাসঙ্গিক ব্যবহার করত না। ওদের প্রজ্ঞা কিংবা ব্যক্তিত্বও ভাল ছিল।ওরা অধিকাংশই গ্রামীন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। কখনও বিদেশে গেছে কিনা তখন পর্যন্ত আমার জানা ছিল না (পরে গেছে কিনা জানিনা।) কিন্তু আরজে হওয়ার পর কি এক অজানা কারণে অদ্ভুতভাবে কথা বলতে শুরু করল।মনে হচ্ছিল ওরা ছেলেবেলা থেকে ব্রিটেন কিংবা আমেরিকা থাকে, তাই বাংলা উচ্চারণে ইংরেজি ভাষার এত প্রভাব! ওদের কথা শুনে খুব হতাশ হয়েছিলাম। মনে মনে রাগও হয়েছিল। সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য ওরা এমন করতে পারল?
কিছুদিন পরে দেখি, নাটকে, সিনেমায় এমনকি গানেও সেই অদ্ভুত উচ্চারণ! ক্রমে ক্রমে সবকিছুতেই ছেয়ে গেল। এরা না জানে ভাল ইংরেজির উচ্চারণ, না জানে বাংলার। এ এক অদ্ভুত সময়। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন এমন উচ্চারণের হিড়িক। এভাবে না বললে স্মার্টনেস প্রকাশ পায় না। কোন নির্বোধ যে এ ভাষার আমদানীকারক আল্লাহ মালুম। এ থেকে পরিত্রাণের পথ কি? কথা বললেই হয়ত বলবেন, আমি ভাষার স্বাধীনতাকে খর্ব করার পক্ষপাতি। মশাই, না।ভাষার বিবর্তন রোধ করা যায় না। রোধ করতে যাওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।তবে বিকৃতি ঠেকানো যেতেই পারে। রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাভাষার বিবর্তনের স্রোতকে সুপথে ধাবমান করার জন্য্ কিছু কিছু পদক্ষেপ পদক্ষেপ আমরা নিতেই পারি।বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য আমাদের স্বজনেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। সে বিবেচনায় এ আর এমন কি? এগুলো কারো অসুবিধা করার জন্য বলছি না। স্রেফ একজন বাঙালি হিসেবে বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা হিসেবেই কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করছি।
এক. সকল প্রচার মাধ্যমে বিদেশী ভাষার আদলে বাংলা উচ্চারণকে আইনতঃ নিষিদ্ধ করতে হবে।রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র কিংবা সংগীতে অশুদ্ধ কিংবা বিকৃত উচ্চারণ (আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রে নয়, কেবলমাত্র বিদেশী ভাষার আদলে বাংলা উচ্চারণের ক্ষেত্রে।) রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। যে সকল প্রচার মাধ্যম আইনের ব্যত্যয় ঘটাবে অর্থাৎ বিকৃত উচ্চারণের পৃষ্ঠপোষকদের জন্য উপযুক্ত শাস্তির বিধান আরোপ করা যেতে পারে। যেমন, সতর্কতা, জরিমানা এমনকি অপরাধ গুরুতর হলে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা যেতে পারে। মাধ্যমে কর্মরত ঘোষক, উপস্থাপক কিংবা আরজে এবং এ জাতীয় অন্যান্য কুশিলবকে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ থেকে বিরত থাকার নিয়ম করতে হবে। সেন্সরবোর্ড অভিনেতা, অভিনেত্রীদের উচ্চারণ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং সমস্যা  থাকলে তা অনুমোদন দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিকৃত উচ্চারণকারী শিল্পীদের সঙ্গীতকে বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। আইন ভঙ্গ করে কোন মাধ্যমে কেউ বিকৃত উচ্চারণের সঙ্গীত প্রচার করলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
দুই. স্কুল কলেজে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ এবং বাক উৎকর্ষ বিষয়ক আবশ্যিক পাঠদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
তিন. বিকৃত উচ্চারণের স্রোত রোধ করার জন্য এবং কোমলমতি শিশু কিশোরদের বিকৃত উচ্চারণে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা যেতে পারে।
চার. সকল আঞ্চলিক ভাষা আমাদের সম্পদ। এ ভাষাতেই রচিত সাহিত্য ও সঙ্গীত বাংলার অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ।সকল আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণের জন্য প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা অসম্মানের নয় বরং গৌরবের। যে সকল লেখক গোষ্ঠি ইদানিং আঞ্চলিক ভাষায় লেখালেখি করছেন তাঁরা কিন্তু আঞ্চলিক ভাষাকে সংরক্ষণের পথ সুগম করছেন। তবে লেখকগণ যদি স্ব স্ব আঞ্চলিক ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষায় যত্নবান হন, তাহলে তাঁরা তাঁদের স্ব স্ব আঞ্চলিক ভাষারই উপকার করবেন।আঞ্চলিক ভাষায় রচিত কিংবা নির্মিত নাটক, চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও এ চেষ্টা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
মায়ের ভাষা বাঁচাতে আমরা এ পদক্ষেপগুলো শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করতেই পারি।
লেখকঃ গায়ক, কবি, গদ্যকার।   
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ঢাকা।       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন