সূচীপত্র

মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৭, ২০১৮

মায়ের সাথে একদিন

আমার মা বড় রাস্তায় গাড়িতে চড়তে ভয় পান। আগে পেতেন না, এখন পান। কেন যেন মা’র প্রেসারটা খুব ওঠানামা করে এখন। নিয়মিত প্রেসারের ওষুধ খেতে হয়। হঠাৎ হঠাৎ হৃদস্পন্দনও বেড়ে যায়। মা ভয় পান, তারচেয়ে বেশি ভয় পাই আমরা। সবসময় ভয়ে থাকি।
পদ্মা পাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া থেকে ঝিটকা-মানিকগঞ্জ সড়ক দিয়ে এসেছি আজ। ঝিটকায় আজ হাটবার ছিল। হাটের ভেতর দিয়ে আসার সময় হঠাৎ মা’র চোখ গেল রাস্তার পাশের একটি দোকানের দিকে। দোকানে ‘মটকা’ বিক্রি করছেন দোকানি। মা বললেন- ‘ওই দ্যাখ, মটকা।’
মাকে বললাম- ‘কিনে আনব, মা?’
মা বললেন- ‘আন্।’
হাটের ভিড়ের মধ্যে নেমে গিয়ে কয়েক পদের মটকা কিনলাম। বাদাম মটকা, নারকেলের মটকা, টানা মটকা, কটকটি এবং আরো দুই পদ। এগুলোর আলাদা নাম নেই। সবই মটকা।
এই ’মটকা’ শব্দটি আমাদের গ্রামের প্রচলিত শব্দ। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের নাম আছে হয়ত। মানিকগঞ্জ অঞ্চলে দেখলাম একে বলে ‘টানা।’ কটকটির সর্বপ্রচলিত শব্দ হল ‘মুরালী।’ আমাদের গাঁয়ে একে কটকটি বললেও অনেককে ‘মুরালী’ বলতেও শুনেছি।
মটকা কিনলাম। মাকে দিলাম খেতে। মা একটু খেলেন। তারপর বললেন- ‘তুই খা। ছোটকালে তুই খালি মটকা খা’ব্যার চাতি। তোর খাওয়ার জুন্যিই আন’ব্যার কইছি।’
মা আর খেলেন না। আমি বুঝলাম মা’র ভাল লাগছে না। এগুলো খাওয়ারও তো বয়স আছে, নাহ? ভাল না লাগলেও মা’কে দেখিয়ে দেখিয়ে অনেকটুকু খেলাম। তারপর বললাম- ‘মুখ বারি দিছে, মা। ইটুক থাক। ওগেরে জুন্যি নিয়্যা যাই?’
মা বললেন- ‘তয় থো।’
মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমাদের গাঁয়ে মটকাঅলারা আসতেন। পুরনো টিন, কাঁচের বোতল, প্লাস্টিক এবং এরকম আরো ভাঙারির বিনিময়ে মটকা পাওয়া যেত ওঁদের কাছে। আমরা ছোটরা কোণা-কাঞ্চিতে গিয়ে এসব ভাঙারির খোঁজ করতাম। এগুলো নিয়ে গিয়ে মটকা খেতাম। যেদিন পেতাম না সেদিন মা’র কাছে পয়সার আবদার করতাম। মা আঁচলে বেঁধে রাখা পয়সা দিতেন আমাদেরকে।যেদিন মা’র কাছে পয়সা থাকত না সেদিন মা বলতেন- ‘উইয়্যা খাইস ন্যা। প্যাট খারাপ ওবেনে। উইয়্যা খাওয়া ভাল্না।’
আামাদের মন খারাপ হত। আব্বা তো আর বাড়িতে থাকতেন না। কাজের জন্য বাইরে থাকতেন।
এমন অনেক হয়েছে যে, মা’র নারকেলে তেলের বোতল থেকে কোন বাটি বা পাত্রে তেল ঢেলে রেখে লুকিয়ে সেই বোতল নিয়ে গিয়েও মটকা খেয়েছি।
সেসব দিনের কথা মনে হচ্ছিল খুব। মা কেমন শিশুর মতো হয়ে গেছেন এখন। গাড়িতে বসে অনেক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার চোখ কেমন ছল ছল করে উঠছিল বারবার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন